প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে বাড়ী থেকে ৩ কি.মি. দুরে আমার আব্বু যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে যাব বলে আবেগ, উচ্ছ্বাস আর উৎকন্ঠায় পরিপূর্ণ আমার মন। তাও আবার আব্বুর স্কুল বলে কথা। ২০১০ সালের জানুয়ারির ১ তারিখে আব্বুর সাথে তার সাইকেলে চেপে শুরু হল আমার নতুন স্কুলে যাওয়া। পরে অবশ্য মোটরসাইকেলে যেতাম। যেতে যেতে রাস্তায় আব্বুর সাথে অনেক অনেক গল্প করতাম। মাস্টার সাহেব বলে পথে অনেকেই আব্বুকে সালাম দিত। প্রথম প্রথম আমি অবাক হতাম, এত মানুষ আব্বুকে সালাম দেয়! তারপর হুট করে একদিন গননা শুরু করলাম। বাড়ী ফিরে বলতাম আজ রাস্তায় ১৪জন আব্বুকে সালাম দিয়েছে, আজ ১৭ জন, আজ ২২ জন। আব্বু শুনে সুন্দর একটা হাসি দিতেন। তখন না বুঝলেও আজ বুঝি সে হাসিতে মিশে ছিল কতটা প্রশান্তি, কতটা তৃপ্তি।
শিক্ষা জীবনে প্রিয় শিক্ষক বলতে গেলে আমার বাবা। অভিনব পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি গ্রুপ ওয়ার্ক, বিতর্ক, দেয়ালিকা, খেলাধুলাতে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। শুধু বাবা বলে নয় একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বলছি, এই সহপাঠ্যক্রমিক বিষয়গুলোকে তার মত করে এত উৎসাহ অন্যকোন শিক্ষকের কাছে পাইনি আমি। তিনি নিজে যেমন সৃজনশীলতা পছন্দ করেন তেমনি সৃজনশীল এবং ব্যতিক্রমী কাজে প্রতিনিয়ত তার শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা যোগান।
নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়ানুবর্তিতার বিষয়ে আব্বু খুব সচেতনতা এবং কঠোরতা অবলম্বন করেন। বর্ষাকালে টানা বর্ষণে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এমন একটি গ্রাম্য স্কুলে পড়া আমার অধিকাংশ সহপাঠী যখন বাসায় ঘুম দিত তখন ছাতা মাথায় কাঁদা মাখা পিচ্ছিল রাস্তায় পায়ে হেটে কিংবা আব্বুর সাইকেলে চরে আমাকে ঠিকই স্কুলে যেতে হত। কারণ সময়মত স্কুলে যাওয়া শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের দায়িত্ব। আব্বুর সাথে এমন ছোটখাটো দায়িত্ব পালন করতে করতে এখন বড় হয়েও অভ্যাসটা রয়ে গেছে। হয়তো এ কারনে যে কাজগুলো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, দায়িত্ব বলে মনে করি কিংবা যেটার দায়িত্বভার আমার উপর অর্পিত হয় তা নিষ্ঠার সাথে যথাযথ ভাবে পালনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সবসময় করি। কারন এটা যে আমার বাবার কাছে শেখা।
সময়ের হেরফের আব্বু নিজেও করতেন না, আমাদেরও করতে দিতেন না। যেকোন কাজে, যেকোনো প্রয়োজনে সময়মত উপস্থিত হওয়ার তাগদাটা সেই ছোটবেলায় আব্বুর কাছে পাওয়া। তাইতো আজও ক্লাসে, টিউশনিতে, সাংগঠনিক মিটিং, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডাবাজি কিংবা অন্যকোন কাজে সময়মত উপস্থিত হওয়ার তাড়নাটা ভেতর থেকে পাই। এইতো বছর তিনেক আগের কথা, কয়েকজন মিলে একটা প্রোগ্রামে চরে যাব বলে আমার এক বান্ধবী সহ সময়মত নিদিষ্ট স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আর বাকিদের ফোন দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের আরেক সফরসঙ্গী এসে আমাদের দেখে বলছিল, "নুসরাত টা এতদিন থেকে আসে অথচ এখনও বুঝলনা যে সময়ের একটু পরে আসতে হবে।"
এ কথা শুনে মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলেছিলাম, "এ আমার শিক্ষক বাবার দেওয়া শিক্ষা।"
সেভাবে ভাবতে গেলে এরকম কত কথা সামনে আসবে, মনে পড়বে কত স্মৃতি। এখনও প্রতিনিয়ত তাঁর কাছে কত কিছু শিখছি। তবে মুখ ফুটে যে কথা বলা হয়নি, বাবা আমি তোমায় বড্ড ভালবাসি।
নুসরাত জাহান
সহ সম্পাদক, বর্ণপ্রপাত