মামার বাড়িতে বংশানুক্রমিক একটা হার আছে। সেই হার ঋত্বিকের দিদিমাকে তার শ্বাশুড়ী দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে মাইমকে দিদিমা। বিশ্ব্দেব বাবু, ঋত্বিকের মামা সেই হার পালিশ করে নিয়ে এসে যত্ন করে তুলে রাখে। পরের দিন সেই হারটা ঋত্বিকের মা রমা দেবী একবার দেখতে চাইল তার ভাই বিশ্বদেব বাবুর কাছে। দিদিকে হারটা দেখানর জন্য আলমারি থেকে বার করতে গিয়ে দেখে হারের বাক্স নেই। জামাকাপড় অগছাল। এই দেখে তিনি চিৎকার করে ওনার স্ত্রী গার্গীকে ডাকেন।
ঋত্বিকের মাইমা মামার ডাক শুনে ঘরে তারাতরি ছুটে আসেন। তাকে দেখতে পেয়ে মামা জিজ্ঞাসা করেন, 'হারের বাক্সটা কোথায় গেল?' মাইমা শুনে অবাক। বললেন, 'দোকান থেকে এনে তুমি তো তুলে রাখলে।' মামা জানলেন, তিনি তুলে রেখেছিলেন আলমারিতে। সেটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, 'জিনিষটা গেল কোথায়? একেবারে বাক্স শুদ্ধু উধাও।'
মাইমার মাথায় হাত। তিনি বললেন, গাঙ্গুলী বাড়ির কত বছরের জিনিষ। হার হারিয়ে যাওয়াটা অমঙ্গলের লক্ষণ। মাইমা ছাড়া আলমারিতে কেউ হাত দেয় না। দিন দশেক আগে মেয়ের বাড়িতে আশীর্বাদ করতে যাবার দিন মাইমা আলমারিতে হাত দিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ঋত্বিক এসে উপস্থিত হয় মামার ঘরে। বিশ্বদেব বাবু ঋত্বিককে হার খূঁজে না পাওয়ার কথাটা জানায়। ঋত্বিক নিজেও চিন্তিত হয়ে পরে। অনুমান করে, এ নিশ্চই বাড়ির লোকের কাজ। সকলের মাথায় হাত। ঋত্বিক মামাকে বলে, একবার পুলিশকে খবর দেবে কি না। বিশ্বদেব বাবু সম্মতি হলেন না। ঋত্বিক বলে পুরো বাড়ি সার্চ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। মাইমা তাতে সম্মত হন। মামা ভাগ্নে মিলে পুরো বাড়ি খুঁজেও পেলেন না।
হারটা না খূঁজে পেয়ে বিশ্ব্দেব বাবু নিজের ঘরে বসলেন। বির্বির করে বলতে লাগলেন, তিনি সোনার জিনিষটা সিন্ধুকে রাখলে এমন ঘটনা হত না। কথাটা শুনে ঋত্বিক সিন্দুকটা একবার দেখতে চায়। বিশ্বদেব বাবু কারণ জানতে চাইলেন। ঋত্বিক সুনিশ্চিত হতে চায় তার মামা ভুল বশত সিন্দুকে রেখে আলমারিতে খূঁজে সময় ব্যয় করছেন।
বিশ্বদেব বাবু ঋত্বিকের হাতে চাবি তুলে দেন। বলে, 'সে এই বিষয় আর মাথা লাগতে পারছে না।' মামাকে জিজ্ঞাস করে, কোন দোকানে হারটা পলিশের জন্য দিয়েছিলেন। জানতে পারে গ্রামের বাজারে ঢোকার মুখে বিজন বাবুর দোকান- বি, জুয়েলারসে। ঋত্বিক সিন্দুকের চাবি খুলে দেখে সিন্দুকের ওপর ফাঁকা গহনার বাক্স। মামার চোখ এড়িয়ে বাক্সটা খুলে দেখে বি জুয়েলারসের নাম। ওখানে একটা কম্পিউটার প্রিন্ট পেল ঋত্বিক। লেখা আছে-
রুপোর তৈরি হারকে সোনার জ্লে ভিজিয়ে
আসল সোনা উধাও করে দিল কোন জ্ন।
এমন নকল সোনার জিনিস কি হবে নিয়ে
তবেই হবে বিয়ে, আসল সোনার মিললে সন্ধান।
মামা জানতে চাইল পাওয়া গেল কিনা। ঋত্বিক বলল না। ভাগ্নে জিজ্ঞাসা করল মামাকে, সিন্দুকে খালি বাক্স রয়েছে। ওটা কোন কাজে লাগবে কি না। বিশ্বদেব বাবু বললেন, না। ফাঁকা বাক্স মানেই আবর্জ্না। বাক্সটা বের করে, সিন্দুক বন্ধ করে মামার হাতে চাবি দিয়ে দিল ঋত্বিক।
মামা বলল ঋত্বিককে, এই রকমের ডিজাইনের হার আবার একটা তৈরি করতে দিতে হবে। ছেলেটি জানতে চাইল মামার কাছে, হারের ছবি আছে। বিশ্বদেব বাবু জানলেন হ্যা। আর বললেন, তিন ভড়ি সোনা দিয়ে হারটা ছিল। ঋত্বিক শুনে বললে, 'মায়ের কাছে শুনেছি। দেখতে পারলে সার্থক হত জন্ম।' এই বলে ঋত্বিক বেরিয়ে যায় বিয়ের কাজের উদ্দেশে।
বিয়ের দিনের গাড়ির খবর সুনিশ্চিত করবার অজুহাতে বি, জুয়েলার্সের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল ভাগ্নে ঋত্বিক। বাজারের মোর আসতেই দেখে দীপ, ঋত্বিকের মামাত ভাই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছে। ভাইকে দেখে ঋত্বিক এগিয়ে আসে। দীপ ঋত্বিককে দেখে বলে, বাজারে কি কারণে সে এসেছে। ঋত্বিক জানায় গাড়ির ব্যপারে শুনিশিত হওয়ার ব্যপারে এসেছে। দীপ সকলের জন্যই চায়ের অর্ডার দিয়ে ঋত্বিককে বলল, ওর সাথে একটা দরকারি কথা আছে। বন্ধুদের সঙ্গে দাদার পরিচয় করিয়ে একটু দুরে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কথা হল।
এদিকে দীপের বন্ধুদের হাতে চা আসতে দীপকে ডাক দেয়। ঋত্বিক মাঝে মাঝে টিভি তে অভিনয় করে বলে অনেকেই চেনে। দীপের বন্ধুদের সাথে চা খেতে খেতে আলাপ সেরে সব কাজ করে বাড়ি ফিরল ঋত্বিক।
ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। ঋত্বিক মামার ঘরে আসে। বাড়ির সকলে এল এক এক করে। বিশ্বদেব বাবু দেখে অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, ওনাদের ঘরে সকলে কেন। ঋত্বিক বলল, তোমার সীতা হার পাওয়া গিয়েছে। বিশ্বদেব বাবু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, 'পাওয়া গিয়েছে। কোথায়?' ঋত্বিক বলে, 'ওটা তোমার কাছেই আছে। তবে অন্য্ রূপে।' বিশ্বদেব বাবু বুঝতে পারলেন, ওনার চালাকিটা ঋত্বিক ধরে ফেলেছে।
ঋত্বিক বলতে আরম্ভ করল, 'বোকার মত কাজ করলে জানাটা সহজ সরল ব্যাপার। তুমি তোমার সীতা হারের ছবিকে কাজে লাগিয়ে একটা নকল গোল্ড প্লেটেড হার তৈরি করেছিলে। মাইমাকে সেটাই তুমি দেখিয়ে সিন্ধুকে গুছিয়ে রেখেছিলে। মাইমা এই সোনা চেনার ব্যপারে কিছুই বোঝে না। তাই মাইমা বিষয়টা বোঝে নি। অন্যদিকে দীপ এই খবরটা পায় বিজন বাবুর ছেলে চন্দনের কাছ থেকে। চন্দন আর দীপ চায়ের দোকানের বন্ধু। আজ সকালে যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম ফাঁকা বাক্সটা নেব কি না, তখন তুমি আবর্জনা বলে আমকে ফেলে দিতে বললে। তুমি যে কাল সকাল বেলা নকল হারটা ডেলিভারি নিয়ে আসবে সেটা দীপ জানত। মাইমকেও বলা ছিল। মাইমা গতকাল, তুমি বিকেলে বাজারে বেরিয়ে যাবার পর, দীপকে হারটা বের করে দেয় সিন্দুক থেকে। আর দীপ ওই হারটা নিয়ে ছাপানো কাগজটা বাক্সে ইচ্ছে করে রেখে দেয়। সিন্দুক খুলতে সেই বাক্সটা আমার হাতে পরে। সব কিছু হাতে পেয়ে আমি বি, জুয়েলার্সে যাই পুর ঘটনাটা জানতে। বেলায় গাড়ির ছুতো করে বাজারে যাওয়ার সময় দীপের সঙ্গে দেখা হয়। ও পুরো ঘটনাটাই আমাকে বলে। এখন বল আসল গহনাটা কোথায়?'
বিশ্বদেব বাবু বললেন, 'সব যখন জেনেই ফেলেচিস, তখন এইটুকু আর বার করতে পারলি না?' ঋত্বিক বলল, সে জানে। তবু সে চায় তার মামা নিজে মুখে সেই কথা যেন বলে।'
বিশ্বদেব বাবু ঋত্বিককে বললেন বাকি ঘটনাটা বলতে। ঋত্বিক বলতে আরম্ভ করল, 'আসল গয়নাটা মামা আমাকে দিয়েছিল প্রায় মাস খানেক আগে। তখন আমি জানতাম না, ওটা সেই গাঙ্গুলী বাড়ির সেই ঐতিহাসিক সীতা হার। কলকাতায় আমাদের দোকানে গিয়ে তুমি পুরনো সোনা দিয়ে নতুন সীতা হার করতে দিয়ে এসেছিলে। সেটা আমি তোমাকে নিজে হাতে এনে দিয়েছি। এই ব্যাপারে মাইমাও জানে না। করণ মাইমা চায় নি এই হারটা পাল্টে নতুন হার গড়তে। এই নিয়ে তোমাদের মধ্য অশান্তি কম হয় নি।'
বিশ্বদেব বাবু বললেন, 'তোর মাইমা বুঝতে চাইছিলেন না, আজকাল মেয়েরা মান্ধাতা আমলের গহনা পছন্দ করে না।'
মাইমা জানতে চাইলেন আলমারিটা অগছাল করল কে? ঋত্বিক বলল মামাকেই জিজ্ঞেস করো। এরপর বিশ্বদেব বাবু নতুন সীতা হারটা সকলকে সিন্দুক থেকে বের করে দেখালেন।
লেখক পরিচিতি
আমি শুভব্রত ব্যানার্জি, কলকাতার বাসিন্দা। ছোটবেলা কেটেছে হলদিয়া নগরে। সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুল হলদিয়া থেকে মাধ্যমিক ও হলদিয়া গভর্নমেন্ট স্পনসারড বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চলে আসি কলকাতায়। তারপর কলেজ, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা- যেমন আঁকা, নাটক, অভিনয় ইত্যাদি। সরকারী চাকরির জ্ন্য পরীক্ষার কম চেষ্টা করি নি। কিন্তু কোন দিন দ্বিতীয় রাউন্ডে ডাক পর্যন্ত আসে নি। বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চলে এলেন নিজের বাড়িতে। আমি বেসরকারি অফিসে কাজ করতে শুরু করি। এখন একটা নাম করা সোনার ব্যবসায়ী দোকানের হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ করি। জীবন যুদ্ধ চালাতে চালাতে লেখা লেখি করি। কিন্তু সব ছিল অর্ন্তনিহিত। বহিপ্রকাশ হয়েছে 2020 সালে মাত্র। কবিতা, ছোট গল্প, ছড়া দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে থাকি। চলচ্চিত্রে অভিনয় আমার আরো একটা দিক। (যবানিকা)
চমৎকার
ReplyDelete