জামানের সপ্ন ।। সৈয়দ রিফাত

 

প্রথমবার মর্গে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো জামানের। প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার পথে দুরে পুকুরের পাশের জীর্ণশীর্ণ এই ঘরটা চোখে পড়তো তার। বেশ নিরিবিলি গা ছমছমে জায়গা। ছোট্ট একতলা ঘরটার বাইরের দিকের পলেস্তারা প্রায় পুরোটা খসে পড়েছে। পুকুরপাড়ের দেওয়াল জুড়ে গজানো গুল্মলতার ঝাঁক আর ছাদের দিকের খানিক ভাঙা অংশ কাছ থেকে দেখলে মনে হতে পারে এখনি বোধহয় ভেঙে পড়বে। জামান অবশ্য ঘরটির এতো কাছে এর আগে কোনোদিন আসেনি। তবে বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলো ওটা লাশকাটা ঘর, সেদিন থেকেই মনে মনে সে ঠিক করে একবার ঘরটাতে উকি দেওয়ার। স্কুলে অনেকবার এ নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনাও করেছে সে। ক্লাসের ফাঁকে সবাই এ নিয়ে গল্প বলায় ওস্তাদ; তবে ঘরের কাছে যেতে কেউ রাজী হয়নি। 
জামানের বাবা আতিউর সাহেব বেশ গম্ভির ধরনের মানুষ। বাবার কাছে প্রথম যেদিন জামান ঘরটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলো, তিনি একটু ভুরু কুঁচকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওখানে মৃতদেহ কাটাকুটি করা হয়।’ বাবা রাগ করতে পারে ভেবে এরবেশি সেদিন আর কিছু আতিউর সাহেবের কাছে জানতে চায়নি জামান। তবে বাড়ি ফিরে প্রশ্নটা পেড়েছিলো তার ছোট মামা পলাশের কাছে। ছোটমামাই প্রথম জামানকে বলে লাশকাটা ঘরের বিভৎস্য সব গল্প। ‘সেখানে থাকে হাতুড়ি, কাচি, ছেনি আর নানা রকম সব যন্ত্র। কেউ মারা গেলে ওগুলো দিয়েই তার হাত পা পেট কাটা হয়। বিশালাকার দেহের ডোম মদ খেয়ে মানুষ কাটে। তার চোখ থাকে ভাটার মত লাল- বলেছিলো জামানের ছোট মামা। নয় বছর বয়সী জামান সেদিন আতঙ্ক আর উত্তেজনা নিয়ে শুনেছিলো ছোটমামার সেসব গল্প। তারপর গল্প শেষ হতেই মামার কাছে বায়না ধরেছিলো একদিন তাকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাওয়ার। মামা বলেছিলো, ‘তুই এখনও অনেক ছোট। আরেকটু বড় হ তারপরে নিয়ে যাবো।’ কিন্তু জামানের তর সয় না। 
প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার পথে দূর থেকে ঘরটা চোখে পড়ে আর সে শুধু ভাবতে থাকে কবে একবার উঁকি দেবে ওখানে। দিনে এসব ভাবে আর রাতে ঘুমিয়ে সপ্ন দেখে, ছোট মামার কাছে শোনা গল্পেরে সেই ডোমকে। বিরাট একটা হাতুড়ি নিয়ে সে মৃত মানুষের মাথা ফাটাচ্ছে। চোখ তার ভাটার মত লাল। ‘আচ্ছা, মাথা ফাটালে মানুষটার কি কষ্ট হয় না? মরা মানুষের পেটই বা কাটতে হবে কেন?’ জামান ভাবে আরে শিউরে ওঠে। তবে মনে মনে পরিকল্পনা করতে থাকে একবার ওই ঘরে উকি দেবেই সে। জামানের মনে অনেক প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর তার জানতে হবে। সুযোগও এসে গেলো খুব তাড়াতাড়ি। 
জামানদের বাড়ি থেকে স্কুল খুব কাছেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খেলার মাঠের পরই বড় রাস্তা। রাস্তা পেরোলেই জামানের স্কুল। সেদিন সকালেও রোজকার মত মায়ের সাথে স্কুলের জন্য রওনা হলো জামান। মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই জামানের চোখে পড়লো স্কুলের গেটে দাড়িয়ে হাওয়াই মিঠইওয়ালা। মায়ের হাত ছাড়িয়ে এক দৌড় দিলো সে হাওয়াই মিঠাইওয়ালার দিকে। জামানের মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বড় রাস্তার উল্টোদিক থেকে ধেয়ে আসা একটি ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেলো জামান। মুহুর্তেই জামানের ছোট্ট দেহ তুলোর মত ভাসতে ভাসতে সড়ক থেকে কয়েক মিটার দূরে যেয়ে পড়লো। হঠাৎ জেগে ওঠা একটি আর্তনাদ যেন হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। 
জামান এখন শুয়ে আছে পুকুর পাড়ের সেই জীর্ণশির্ন ঘরটাতে একটি শীতল লোহার বেডে। লাশকাটা ঘরের এতো কাছে এসেও জামানের মধ্যে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। জানার জন্য প্রশ্নগুলোও তাকে নাড়া দিচ্ছে না। লাশকাটা ঘরের বাইরে অঝোর ধারায় কাঁদছে জামানের মা, বাবা আতিউর রহমান আর ছোট মামা পলাশ। তবে জামান তাদের বলতে পারছে না তার সপ্ন আজকে সত্যি হতে যাচ্ছে। হাতুড়ি হাতে বিরাটাকায় এক লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। চোখ তার ভাটার মত লাল। নিশ্চয়ই হাতুড়ির এক বাড়িতে জামানের মাথা ফাটাবে সে। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।