ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ দেশকে প্রকৃতির রূপসী কন্যাও বলা হয়। এই প্রকৃতি রূপসী থেকে কখনো কখনো হাজির হয় রণচণ্ডী রূপ নিয়ে। প্রকৃতির এই রূপকেই আমরা বলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সড়ক দুর্ঘটনার মতো সমস্যার দেশে একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো বন্যা। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বন্যা এদেশের নিত্যসঙ্গী। এছাড়া সারা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নদ–নদী, খাল-বিল। প্রতি বছর বর্ষাকালে দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এতে সমস্ত নদী–নালা, খাল-বিল কানায় কানায় ভরে ওঠে। এছাড়া হিমালয়ের বরফগলা পানির কারণে নদীর দু–কূল ছাপিয়ে বন্যা হয়। ফলে ডুবে যায় গ্রামের পর গ্রাম, ফসলের মাঠ, মাছের ঘেরসহ সব আবাদ ও সম্পদ। এদেশে বন্যার ফলে কোনো না কোনো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ি। যার ফলে দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এদেশের মানুষ বহুকাল আগে থেকেই বন্যার সাথে লড়াই করে আসছে। দেশের ইতিহাসে সর্বশেষ ২০০৮ সালের ভয়াবহ বন্যা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মানুষ বন্যার ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও পাচ্ছে না। এদেশে বন্যার অন্যতম কারণ হলো অতিবৃষ্টি। দেশে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো ২৩২০ মিলিমিটার যার ৮০ শতাংশের বেশি জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সংঘটিত হয়। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে। বন্যার আরও কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ঢল, হিমালয় থেকে নেমে আসা বিপুল জলরাশি। এটি ভারত ও নেপালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পতিত হয়। এ পানি প্রবলবেগে প্রবাহিত হওয়ায় এর প্রবল চাপের কারণে নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে বন্যার সৃষ্টি করে। এছাড়াও আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলেই রয়েছে বড় বড় নিম্নাঞ্চল ও ছোট জলাভূমি। এগুলো প্রধান তিনটি নদীর পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু পাহাড় কাটা, বনভূমি উজাড় করা, আবর্জনা ফেলে স্তূপ করা ইত্যাদি কারণে এগুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
আমাদের দেশে সংঘটিত বন্যার জন্য মানবসৃষ্ট কারণ বেশি দায়ী৷ মানুষ জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য নদী অববাহিকায় ব্রিজ নির্মাণ করেছে। এছাড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। নদী তীর বরাবর বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর পানি অববাহিকায় প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলি বালি সঞ্চিত হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এজন্য সরকারের উচিত প্রতি বছর প্রধান নদীগুলো খনন করা৷ এছাড়া দেশের অনেক নদী এখন মানুষের বেদখলে। অবাধে নদী দখল করে চলছে যথেচ্ছা ব্যবহার। ফলে লোকালয়ের পানি জমে সেখানেই বন্যার সংঘটিত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্প অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর দখলদারদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক নদী ইতিমধ্যে দখল মুক্ত হয়েছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
বর্ষা মৌসুম আসলেই দেশের গ্রামগুলোতে স্থানীয় সরকারের দূর্নীতি ও অনিয়ম পরিষ্কার ফুটে ওঠে। একটু বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়, ইট উঠে গর্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে রাস্তা ধসে যায়। রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের কিছুমাত্র খরচ করে বাকি টাকা এলাকার প্রভাবশালীদের যোগ সাজশে আত্মসাৎ করা হয়। যার না আছে কোনো জবাবদিহিতা আর না-ই কোনো তদারকি।
বাংলাদেশের বন্যার একটি প্রধান কারণ হলো পশ্চিম বঙ্গের ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধ নির্মাণের পূর্বে ভাগীরথী নদীতে বর্ষাকালে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১, ৩০, ০০০ ঘনফুট পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পর তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৮০, ০০০ ঘনফুট। এ হ্রাসপ্রাপ্ত ৫০, ০০০ ঘনফুট পানি বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি করছে। ভারত প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে। তখন পানির অভাবে আশেপাশের এলাকায় কোনো ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অনেক বড় বিরূপ প্রভাব ফেলে। আবার বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কার সবগুলো গেট একসঙ্গে খুলে দেয়। এর ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে বন্যা হয়।
বন্যার কবলে পরা মানুষদের ত্রাণ দেওয়া ব্যতিত বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও নানা অব্যবস্থাপনা ও সঠিক প্রকল্প প্রণয়নের অভাবে তা তেমন ফলপ্রসূ হয় নি। সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ইয়াস তা প্রমাণ করে।
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বয়ংক্রিয় জোয়ার বিরোধী গেটের মতো অবকাঠামো দ্বারা সাগরের জোয়ারের অনুপ্রবেশ রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া নিম্নাঞ্চলে বেশি বেশি বৃক্ষ রোপন করা যেতে পারে। এতে করে পানি প্রবাহের সময় গাছের মূলে বাঁধা পেয়ে তা ভূগর্ভে চলে যেতে পারে। নদী ভাঙন রোধ করার পাশাপাশি টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। নদীর দু'ধারে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে যেন মাটি ধরে রাখে৷
দীর্ঘ দেড় বছর ধরে দেশব্যাপী চলছে ভয়াবহ জাতীয় দুর্যোগ। এতে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে। জনগণ এক চরম সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে যার শেষ কবে কেউ জানে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মানুষের ওপর এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শত শত মানুষ ঘর-বাড়ি, আবাদি ফসল, জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। পাশাপাশি প্রতি বছর বন্যায় অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দারিদ্র্যের হার চরমভাবে বৃদ্ধি পায়। খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতি সরকারের একার পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায় থাকে। বন্যার্তদের জন্য দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষ সম্মিলিতভাবে বন্যায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো যেতে পারে। খুব বড় পরিসরে সাহায্য করতে না পারলেও তাদের জন্য
পরিষ্কার পানি, জরুরি ঔষধপত্র, দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যায়। এছাড়া বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সতর্কতা মূলক প্রচারণা, বন্যাকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে তাদের অবহিত করা। এতে তাদের ক্ষয়–ক্ষতি বা প্রাণহানি কমতে পারে। বন্যায় আক্রান্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, সেখানে তাদের পূনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে এখন আর বসে থাকা চলে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধ করা যায় এবং বন্যায় ক্ষয়–ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।