শীতের সকাল।চারদিকে কুয়াশা। কুয়াশা ভেদ করে হাল্কা হাল্কা রোদ ছড়াচ্ছে সকালের সূর্য। আমি ক্যাম্পাসের বারান্দায় বই হাতে দাঁড়িয়ে। পাশে রাফি ফোনে গেম খেলছে। সকালের আকাশের দিগন্ত জুড়ে ওঠা সূর্যের মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে আমার গাঁয়ে। অন্যরকম অনুভূতি বোধ হচ্ছে সূর্যের মিষ্টি রোদে।
হঠাৎ চোখ পড়লো! ক্যাম্পাসের সামনে থাকা ফুলের সেই ছোট্ট বাগানটির দিকে। দু-চোখ ভরে দেখছি, একটু খানি শিশিরের ছোঁয়াতে বাগানের সব কলি গুলো কিভাবে ফুল হয়ে ফুটেছে? আমি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি। তবুও মন বলছে, প্রকৃতি যদি আরেকটু সুন্দর হতো...!!
হাতের বইটা বন্ধ করে হারালাম কল্পনার অতল সাগরে....
সুন্দর....
জীবন সুন্দর, অনুভূতি সুন্দর!
ভোরবেলা পাখির কোলাহল সুন্দর।
বাগানের চারাগুলো সময়ের সাথে বেড়ে উঠা,
একটুখানি শিশিরের ছোঁয়ায়!
কলিগুলো সব ফুল হয়ে ফোটা।
সেই শিশির জমাট ফুলে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে!
প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে...
প্রশংসায় মেতে ওঠা সুন্দর।
সূর্য ওঠা,সূর্য ডুবা
সারাদিন আলো দেয়া,
মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে
লুকোচুরি খেলা...
সুন্দর! সব-ই সুন্দর।
আকাশ জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ওঠা,
আবার অঝড়ে টিপটিপ বৃষ্টি ঝড়া।
জোৎস্না রাতে পূর্নিমার চাঁদ ওঠা,
সেই আলোয় কবির কবিতা
আলোকিত করা____
সুন্দর! সব-ই সুন্দর।
মরিতে চাইনা আমি
ছাড়িয়া সুন্দর এই ভূবণ।
বাঁচতে চাই,আমি বাঁচতে চাই।।
দু-এক মুঠো রঙিন স্বপ্ন নিয়ে
কাঁটাতে চাই এ ভুবনে!সুন্দর জীবন।
তখন ঘড়ির কাঁটায় আনুমানিক পৌনে এগারো টা। হঠাৎ দক্ষিণা বাতাস বইছে,সঙ্গে এক খন্ড মেঘের আনাগোনা,। মেঘখন্ড যেন জুড়ে বসলো ঠিক সূর্যের মাঝখানে! মুহূর্তেই নিভে গেল পৃথিবীর সীমাহীন ঝলমলে উজ্জ্বল আলো। পৃথিবী জুড়ে বিজন মূর্তির ছায়ালোক। এমন প্রকৃতিতে আমার অবিষাদ শান্ত হৃদয় ভাসছে। চির নিস্তব্ধ সোল্লাসে আধ কাপ চায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে....!
আমার ক্লাসমেট রাফিকে ডাক দিয়ে বললাম- দোস, এই সুন্দর প্রকৃতি আর মন শীতল করা হাওয়া থেকে চোখ দুটো আর মন কোনভাবেই যেতে চাচ্ছে না। প্লিজ দোস!এক কাপ....
এটুকু বলতেই রাফির আর বুঝতে বাকি রইলো না! আমি এক কাপ কী চাইব? বা চাইতে পারি?
আচ্ছা দিচ্ছি দাঁড়া।
রাফি চা আনতে চলে গেল।
আমি চা প্রেমী। আমি বড্ড চা প্রেমী!
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ভাষা খুঁজছি।
কী নির্মল নিষ্পাপ গাছের সবুজ পাতা!
তবুও বৃষ্টির ফোঁটা এসে প্রতিটি
পাতাকে এলোমেলো করে প্রকৃতিকে পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের জীবনেও বৈশাখ আর আষাঢ়ের বর্ষা মৌসুমের মতো যদি ঋতু থাকতো! তাহলে কতোই না ভালো হতো। বৈশাখ মৌসুম যেমন ভাবে বৃষ্টি ঝড়িয়ে প্রকৃতির সমস্ত ধুলো, ময়লা নিচে ফেলে দিয়ে প্রকৃতিকে সুন্দর ফুরফুরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলে।তেমনি বর্ষায় খাল বিলে পানি এসে বাসা বাঁধে। আসে একা কিন্তু ফেরার পথে নিয়ে যায় খাল-বিলের সমস্ত ময়লা-আবর্জনা। আমাদের ভালো থাকার জন্য। আমাদের জীবনের সব দুঃখ, কষ্টগুলো ধুয়ে মুছে ফেলার জন্য! খুব জরুরী ছিলো আষাঢ়ের বর্ষার।
যদি থাকতো! থাকতেই তো পারতো? তাহলে এমন কী হতো? বরং আমরা একটু সুখে থাকতে পারতাম।
হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের কলেজের দপ্তরি দেলোয়ার আংকেল দুই হাতে দুইটি বাজারের ব্যাগ,আর কাঁধে তার সন্তানকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কলেজের গেট গিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। আমি দৌড়ে এগিয়ে গেলাম। কাঁধে বসা ছেলেটি ভিজে গেছে। তাই আমি তার হাতের ব্যাগ না নিয়ে ছেলেকে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না আমি তার কাঁধ থেকে তার ছেলেকে নিতে পারলাম না। তার হাত থেকে ব্যাগ নিলাম।
বাবা-ছেলের শরীর ভিজে একাকার। রুম থেকে তোয়ালে বের করে দিলাম। গাঁ ভালো করে মুছতে বললাম।
বাবার কাঁধ থেকে নামানোর পর থেকেই কান্না করছে ছেলেটা। ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে কান্না।
এরইমধ্যে চা নিয়ে এলো রাফি।
কী বাবু এভাবে কান্না করছো কেন? রাফি বলল।
ছেলেটি কোন জবাব দিলো না।
আমি চা হাতে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
এবার রাফি বাবুটার কাছে গিয়ে তার দু গালে হাত রেখে আদর করছে। বাচ্চা দেখলে আবার রাফির মাথা ঠিক থাকে না।
রাফি আদর করছে আর বলছে - কী হয়েছে বাবু? কান্না করো না, তোমায় মারছে তোমার আব্বু? এটা বলতে বলতে রাফি বাবুটাকে কোলে তুলে নিলো।
ছেলে বল কিনবে বলে সেই বায়না ধরে বাড়ি থেকে আমার সাথে বাজারে এসেছে।
দেলোয়ার মিয়ার কথা শেষ করতে না দিয়েই রাফি বলে উঠলো- তুমি একটা বল চেয়েছো? কান্না করো না আমি তোমাকে একটা বল দিব।
দেলোয়ার মিয়া আবার বলতে শুরু করলেন, বল কিনে দিয়েছি। এখন সেই দোকানে গিয়ে নয়শত টাকার একটা রিমোটি গাড়ি কিনে দিতে বলে, সেটা না নিয়ে দোকান থেকে আসবে না। তাই জোর করে নিয়ে আসাতে কান্না করছে। কান্না থামছেই না। এতো টাকা কই পাব আমি? আজ মাসের পঁচিশ তারিখ। এ মাসের আরও পাঁচদিন বাকি। সংসার কিভাবে চালাব এই পাঁচদিন! তার উপরে তোর এত এত বায়না আমার আর সর্য্য হচ্ছে না।
(ক্ষণজন্মের কিছু কথা ।। নাসরিন সুলতানা রহমান)