আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি জন্মেছিলাম পুর্ব বাংলার খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার অন্তর্গত কপোতাক্ষ তীরের গ্রাম রাড়ুলির বিখ্যাত রায় চৌধুরী পরিবারের প্রাচীন চকমিলান জমিদার বাড়ির অন্দরে। একে তো আমার পুর্বপুরুষ দেওয়ান মানিকলাল রায়চৌধুরী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে রায়ের আলি বা রাড়ুলি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে জমিদার হিসেবে অনেক কল্যাণমুলক কাজ ও বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করেন বলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তদুপরি আমার সেজঠাকুর্দামশায় বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সেজন্য গ্রামে আমাদের পরিবারকে মানুষ সম্মানের চোখে দেখত। আমার বাবা চারুচন্দ্র রায়চৌধুরী গ্রামে আচার্য্যদেব প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলের মাষ্টারমশাই ছিলেন ও ছাত্রগতপ্রাণ হওয়াতে গ্রামের মানুষ ও ছাত্রেরা তাকে মাথায় তুলে রাখত।
আমার ছোটবেলায়, গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বোধবুদ্ধি হবার পর থেকে দেখেছি দেশটার নাম পুর্ব পাকিস্তান। অবশ্য আমার বাবা জোরের সাথে বলতেন তিনি জন্মেছেন এই বাড়িতে, অখন্ড ভারতবর্ষে। আজ দেশটার নাম যদি পাকিস্তান হয় তবুও তার সাত পুরুষের ভিটেমাটির উত্তরাধিকার মিথ্যে হয়ে যায় না। কিন্তু আমি যেহেতু খন্ডিত বাংলায়, অস্থির রাজনৈতিক পটভূমিতে জন্মেছিলাম এবং দেশটার নাম তখন পুর্ব পাকিস্তান, আর সবার মত উর্দুভাষী অত্যাচারী শাসক থেকে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার ইচ্ছা ঐ ছোটবেলাতেই প্রবল হয়েছিল। তখন ভাবতেও পারিনি প্রতিকুল পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদেরকেই নিজের মাটি থেকে উৎখাত করে দেবে এবং ভারতবর্ষ আমার আশ্রয়স্থল হবে এবং ভারতীয় হিসেবে আমি গর্বিত হব।
এখন বলি ছোটবেলায় আমাদের পুর্ব বাংলার সেই উত্তাল সময়ের কথা। আমাদের রাড়ুলি গ্রাম ছিল কপোতাক্ষ নদ বেষ্টিত এবং বেশ বর্ধিষ্ণু। চাষবাস ব্যবসায় গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল এবং তারা শান্তিতে বাস করত। আবাদের জমি থেকে নৌকো করে ধান আসত আমাদের বাড়ির গোলায়। গ্রামের হাইস্কুলে আশেপাশের গ্রাম থেকেও ছেলেরা পড়তে আসত,আমাদের বাড়ির সদর পুকুরের ও পাড়ে ছিল গ্রামের কোঅপরেটিভ ব্যংক আর আমরা পড়তাম গ্রামের ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ে। প্রসঙ্গত এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই আমার সেজ ঠাকুর্দামশায় আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত। আমাদের স্কুলে প্রথমে গাইতে হত জাতীয় সংগীত, ' পাক সাদ জমিন সাদ বাদ,কিসওয়ারে হাসিন সাদ বাদ '---মানে না বোঝার এই উর্দু গান গাইতে ঐ ছোটবেলাতেই আমার মনে বিরোধ ছিল এবং প্রায়ই আমি ঠোঁট নাড়াতাম না। স্কুলের মাষ্টারমশাই ও দিদিমনিরাও ছিলেন বাঙালি চেতনার পন্থী, তারাও কিছু বলতেন না। এর পরেই প্রার্থনা সংগীত ছিল, ' আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...', সেটি আমরা সব মেয়েরা উৎসাহের সাথে জোরে জোরে গাইতাম। বাড়িতে ফিরে মায়ের কাছে অনুযোগ করতাম আমরা কেন উর্দু গান গাইব? আমার মা খুলনা শহরের করোনেশন গার্লস ইংলিশ হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করা শিক্ষিতা মহিলা ও তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তিনিই আমাদের বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে কিভাবে রফিক বরকতেরা শহীদ হয়েছিলেন সে গল্প করতেন, এ ও বলেছিলেন চাপিয়ে দেওয়া এই উর্দু শাসন বেশিদিন টিকতে পারে না। আমার শিক্ষক বাবার কাছে বেশ কিছু পাশ করে যাওয়া বড় ছাত্ররা আসত। সামনের কাছারির ঘরে বসে বাবাকে বলত,' স্যার, এ অবস্থা চলতে পারে না,আমরা চলতে দেব না'। এরা সব পরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি তখনকার সরকার স্কুল ছুটি না দিলেও আমাদের এলাকার সব স্কুলগুলি কার্যত ছুটি হত। তবে আমরা সবাই সেদিন স্কুলে যেতাম। টেবিলের উপর বই লম্বা করে রেখে শহীদ স্মারক করা হত। শিক্ষক ছাত্র ছাত্রী সবাই গান আবৃত্তি বক্তব্যের মাধ্যমে ভাষা শহীদ দিবস পালন করতাম। মনে আছে মায়ের শেখানো,'মোদের গরব, মোদের আশা,আ মরি বাংলা ভাষা' গানটি আমি গাইতাম। শুধু হাইস্কুল বা আমাদের স্কুল নয়, সরকারি ইউনিয়ন বোর্ডেও ভাষাদিবস পালন করা হত। মনে রাখতে হবে দেশ তখন কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের অধীন। যেহেতু আমাদের এলাকার সবাই মুক্তচিন্তা ও বাঙালি অস্মিতায় বিশ্বাসী ছিল তাই অনেক প্রতিকুলতা সয়েও সপ্তাহ ব্যাপী এই অনুষ্ঠান চলত। একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা ছাত্র ছাত্রীরা তো বটেই এলাকার সব মানুষ জুতো পরতেন না, রাস্তাতেও সবাই খালি পায়ে চলতেন। এদিন কেউ সাইকেল চড়তেন না, সবাই পায়ে হেটে যাতায়াত করতেন। এমন ভাবেই চলেছিল সত্তর সাল পর্যন্ত বরং বাঙালি চেতনার সম্মানবোধে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়েছিল। মাঝে পয়ষট্টি সালের প্রথম দিকে আমাদের গ্রামের কাছাকাছি বাগেরহাটে ভয়ানক রায়টে হিন্দু নিধন শুরু হয়,আমার বাবা আমাদের নিয়ে কোলকাতার কাছাকাছি আত্মীয়ের বাড়ি এসে ওঠেন। এরপর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয় । অবশেষে সব শান্ত হলে প্রায় সাত আট মাস পরে আমরা আবার রাড়ুলি গ্রামে ফিরে যাই। মা তখন বলেছিলেন ডাল ভাত খাব তবু ঐ নিরাপত্তাহীনতায় ফিরে যাব না। সেবার ফিরে এলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যরা চলে গেলেও বাবার মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররা আমাদের বাড়ি পাহারা দিত,আমরা তখনও যাই নি। কিন্তু রাজাকারদের সাহায্য নিয়ে খানসেনারা প্রায় আমাদের গ্রামের কাছে চলে আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তুমুল লড়াই চলছে, মনে আছে আলম নামে বাবার এক মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র যুদ্ধে মারা গেছিল। অন্য ছাত্ররা রাতারাতি আমাদের অন্য পথ দিয়ে নৌকো কালো কাপড়ে ঢেকে এক মুসলিম মাঝির সাথে এপার বাংলায় আসার ব্যবস্থা করে দেয়। মা আর কিছুতেই পরে ফিরে যেতে চান নি। আমরাও আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে যাই নি। আমাদের রাড়ুলির বাড়ি, বিজ্ঞানীর বাড়ি বলে এখন বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণ করেছেন।
( এ যেন এক শোকগাথা, অন্তর উৎসারিত দীর্ঘ শ্বাস।)
শিখা সেনগুপ্ত(রায়চৌধুরি)
64,আদর্শ পল্লী, বিরাটি
কোলকাতা--700051
আপনার লেখা পড়ে চোখে জল এসে গেল।
ReplyDelete