মহাকাশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ও দূরবর্তী নক্ষত্র Earendel (WHL0137-LS) ।। মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল




মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নৌ-পরিচালন ও মহাকাশ প্রশাসনের (NASA) হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে (Hubble Space Telescope বা HST) জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের জন্মের পর প্রথম বিলিয়ন বছর থেকে পরিচিত সবচেয়ে শক্তিশালী বিবর্ধিত ছায়াপথ WHL0137-zD1 এর মধ্যে বিদ্যমান একটি নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন । ছায়াপথটির ডাকনাম হচ্ছে Sunrise Arc । পৃথিবী থেকে অপার মহাবিশ্বের ঐ ছায়াপথে এখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে দূরবর্তী নক্ষত্রটির নাম হচ্ছে WHL0137-LS । ২০২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নক্ষত্রটি আবিষ্কৃৃত হয় । এ অভূতপূর্ব আবিষ্কারের একটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত হয়েছে । বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রটির ডাকনাম দিয়েছেন ইয়ারেণ্ডেল (Earendel), যেটি পুরোনো ইংরেজি নাম থেকে এসেছে । ইয়ারেণ্ডেল অর্থ হচ্ছে Morning star (ভোরের নক্ষত্র) বা Rising light (উদীয়মান আলো) । তাই নক্ষত্রটিকে ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্র বলা হয় । উল্লেখ্য যে: ইংরেজ লেখক এবং ফিলোলজিস্ট John Ronald Reuel Tolkien CBE FRSL এর একটি জনপ্রিয় বই হচ্ছে Eärendil । যেখানে পৌরাণিক কাহিনী সিলমারিলিয়নের (Silmarillion) একটি চরিত্রের নাম হচ্ছে Half-elven, যিনি একটি দীপ্তিময় রত্ন নিয়ে আকাশে ভ্রমণ করেছিলেন যেটি একটি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল ছিল । চাঞ্চল্যকর এ নক্ষত্রের অন্যান্য নামগুলো হচ্ছে: WHL-J24.3324-8.477, WHL J013719.8-082841, PSZ1 G155.25-68.42, RM J013725.0-082722.7 । দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময় হচ্ছে মহাকাশের চতুর্মাত্রিক অবস্থান । এ বিশাল মহাবিশ্বে কোনো মহাজাগতিক বস্তুর টান অন্য আরেকটি মহাজাগতিক বস্তুর উপর বিদ্যমান থাকে । এটিই হচ্ছে অভিকর্ষ বল (Gravitational force), যা আলোর পথকে বেঁকে বা বক্র করে দেয় । একটি বৃহৎ ছায়াপথ স্তবক WHL0137-08 এর মধ্যে স্বাগতিক WHL0137-zD1 বা Sunrise Arc ছায়াপথে বিদ্যমান দূরবর্তী বস্তুটিকে (নক্ষত্র) মহাকর্ষীয় অক্ষিকাচের (Gravitational lensing) প্রভাবের মাধ্যমে বড় করার কারণেই ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটিকে দেখা সম্ভব হয়েছে । এ প্রক্রিয়াটি যখন ঘটে তখন নিকটবর্তী বস্তু দূরবর্তী বস্তুর জন্য একটি বিবর্ধক কাচের মতো কাজ করে । মাধ্যাকর্ষণের কারণে দূরবর্তী মহাকাশে পটভূমির ছায়াপথগুলোর আলোকে একটি দীর্ঘ অর্ধচন্দ্রাকারে বিকৃত করে বড় দেখায় । হস্তক্ষেপকারী WHL0137-08 ছায়াপথ স্তবকের মাধ্যাকর্ষণ ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রের আলোকে বেঁকে দেয় এবং এটিকে কমপক্ষে ৪০০০ গুণ (Factor) বিবর্ধিত করে । মানব সৃষ্ট অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রকৃতির সম্মিলিত শক্তির কারণেই নক্ষত্রটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে ।। মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের কারণে প্রাচীনতম এবং সৌরমণ্ডল থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটি প্রায় ২৮ বিলিয়ন (৮.৬ বিলিয়ন পার্সেক বা ২ হাজার ৮০০ কোটি) আলোকবর্ষ দূরে Cetus নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত । বিস্ময়কর যে, এ অতি দূরবর্তী নক্ষত্রটি থেকে আমাদের কাছে আলো পৌঁছাতে প্রায় ১২৯০ কোটি বছর সময় লেগেছে । কারণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন (১৩৮০ কোটি) বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া প্রাচীন এক মহাপরমাণুর অতি শক্তিশালী মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বছর পর ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটি গঠিত হয়েছিল । ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটি ৬.২±০.১ লাল স্থানান্তর (Redshift) হওয়ার ফলে নক্ষত্র থেকে বর্তমানে আমরা যে আলো দেখতে পাচ্ছি সেটি ১২.৯ বিলিয়ন বছর (১২৯০ কোটি বছর) আগে ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্র থেকে তার যাত্রা শুরু করেছিল, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের ১ বিলিয়ন বছরেরও কম (প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বছর পরে) সময় পর নক্ষত্রটি তার আলোকরশ্মি নির্গত করতে শুরু করেছিল । সুতরাং, ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রের যে আলো এ মুহূর্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি তা ঐ নক্ষত্রটির বর্তমান অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে না । বিজ্ঞানীরা বলেন যে, সবচেয়ে প্রাচীন এ নক্ষত্রটি অনেক আগেই মরে গেছে এবং এখন আর এটির কোনো অস্তিত্ব নেই । মহাবিস্ফোরণের ফলে অসংখ্য নক্ষত্র, নাক্ষত্রিক অবশেষ, গ্রহ, গ্রহাণু, উল্কা, ধূমকেতু, আন্তঃগ্রহীয় ধূলি মেঘ, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস, ধূলিকণা, মহাজাগতিক অদৃশ্য পদার্থ, নীহারিকা, সৌরজগৎ এবং ছায়াপথ ইত্যাদি নিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল । মহাকালের পথ পরিক্রমায় এ অপার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে । যাই হোক, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে ১৪.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ (৪.৪ বিলিয়ন পার্সেক) দূরবর্তী পূর্বের নথিভুক্ত আরো একটি আবিষ্কৃত নক্ষত্রের নাম হচ্ছে MACS J1149+2223 Lensed Star 1 । এ নক্ষত্রটি ইকারাস (Icarus) নামেও পরিচিত । অতি দৈত্যাকার (Supergiant) নীল নক্ষত্রটি উত্তর গোলার্ধের Leo নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত এবং বিশাল ছায়াপথ স্তবকের মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা বিবর্ধিত হচ্ছে । মহাবিস্ফোরণের ৪.৪ বিলিয়ন বছর সময় পরে ইকারাস নক্ষত্রটি থেকে আলোকরশ্মি নির্গত হয়েছিল । জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রটির লাল স্থানান্তর ১.৫ (Redshift 1.5) উল্লেখ করেছেন । কারণ, মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে দূরবর্তী বস্তুগুলো থেকে দীর্ঘতর আলো বিস্তৃত বা স্থানান্তরিত হয়, যখন এটি লালতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আমাদের দিকে ভ্রমণ করে । এছাড়া, জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র (James Webb Space Telescope বা Webb বা JWST) ব্যবহার করে একটি গবেষক দল সম্প্রতি মহাকর্ষীয় অক্ষিকাচযুক্ত একটি একক, অত্যন্ত বিবর্ধিত ও লাল দৈত্য কুইল্লুর (Quyllur) নক্ষত্রকে চিহ্নিত করে যেটি মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর পর পর্যবেক্ষিত হয় । নক্ষত্রটি এতো দূরে যে এর আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে ১০.৭ বিলিয়ন বছর সময় নিয়েছে । এ নক্ষত্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩৫০০ কেলভিন এবং মহাবিশ্বের বয়স যখন ৩.১ বিলিয়ন বছর তখন তার অস্তিত্ব ছিল । কুইল্লুর নক্ষত্র হচ্ছে মহাজাগতিক দূরত্বে পাওয়া প্রথম লাল দৈত্য নক্ষত্র ।ইয়ারেণ্ডেলের মতো মহাজগতে এমন বিশাল দূরত্বের নক্ষত্রগুলোকে মহাকর্ষীয় অক্ষিকাচের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে, যা প্রায় ১০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে । এ কৌশলের মাধ্যমে মহাবিশ্বে সেই রকম কিছু নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, যেমন: পৃথিবী থেকে ১০.৯ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে Sunburst ছায়াপথের একটি পরিবর্তনশীল Godzilla নক্ষত্রকে (Redshift z = 2.37) । ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্র আবিষ্কার মহাবিশ্বের দূরবর্তী অতীতের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে এবং ছায়াপথসংক্রান্ত বিবর্তনের (Galactic evolution) প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিফলন ঘটায় । নাক্ষত্রিক পদার্থবিদ্যার জন্য এ আবিষ্কারগুলো মহাবিশ্বের একটি নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে । বিজ্ঞানীদের জন্য এটি একটি নতুন বিষয়বস্তু যা প্রাথমিক মহাবিশ্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন করছে । যেখানে একসময় ছায়াপথগুলো ছিল ক্ষুদ্রতম সনাক্তযোগ্য মহাজাগতিক বস্তু । ধারণা করা হয় যে, মহাবিস্ফোরণে তৈরি মহাবিশ্বের আদিম বা কাঁচা উপাদান হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম দ্বারা গঠিত ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটি প্রথম প্রজন্মের । এ নক্ষত্রটি যে পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়েছিল আমাদের সূর্যের মতো দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের নক্ষত্রগুলো ঐ সকল পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়নি ।জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উচ্চতর সংবেদনশীলতা ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণে নক্ষত্রটি আসলে একটি একক নক্ষত্র কি-না এবং নক্ষত্রটিতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী কোনো উপাদান আছে কি-না তা প্রকাশ করবে । দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির Near-Infrared Camera (NIRCam) পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ইয়ারেণ্ডেল হচ্ছে একটি অতিকায় B-type নক্ষত্র, যা আমাদের সূর্যের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি উষ্ণ এবং প্রায় এক মিলিয়ন গুণ বেশি উজ্জ্বল । ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রটি তার চারপাশে শীতল ও লাল রঙের একটি সঙ্গী নক্ষত্রের ইঙ্গিতসহ আকর্ষণীয় বিবরণ প্রকাশ করে । যদি ইয়ারেণ্ডেল একটি একক নক্ষত্র হয়ে থাকে তবে তার তাপমাত্রা ১৩০০০ – ১৬৬০০০ কেলভিন (K) এবং বিবর্ধনের উপর নির্ভর করে এটির ৬৩১০০০ – ৩৯৮১০০০ সৌর দীপ্তি বা উজ্জ্বলতা (L☉) হবে । সম্ভবত ইয়ারেণ্ডেল একটি একক নক্ষত্র নাও হতে পারে, কারণ নক্ষত্রের বর্ণালী শক্তি বন্টন বা বিতরণে একটি শক্তিশালী Balmer বিরতি রয়েছে যা ১৩০০০ কেলভিনের নিচে তাপমাত্রা এবং একটি নীল অতিবেগুনি (Ultraviolet বা UV) ঢালের নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য যা ২০০০০ কেলভিনের উপর তাপমাত্রার নক্ষত্রে উপস্থিত থাকে । এটি সম্ভব যে ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্র হচ্ছে একটি বাইনারি (Binary), যার দুটি উপাদান রয়েছে যেখানে একটি অন্যটির (৯০০০ কেলভিন) চেয়ে বেশি উজ্জ্বল এবং অনেক বেশি গরম (৩৪০০০ কেলভিন) । সীমিত পরিমাণ তথ্যের কারণে পরিমাত্রাগুলো (Parameter) ভালোভাবে সীমাবদ্ধ নয় । যদি দুটি নক্ষত্র তন্ত্র বা ব্যবস্থায় থাকে তবে তাদের বিভিন্ন বিবর্ধন বা বিস্তৃতি থাকতে পারে, যা পরিমাত্রাগুলোকে আরো অনিশ্চিত করে তোলে । জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বর্তমানে Sunrise Arc Galaxy এবং ইয়ারেণ্ডেল নক্ষত্রকে জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের NIRSpec (Near-Infrared Spectrograph) ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ থেকে তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করছেন, যা ঐ ছায়াপথের জন্য সুনির্দিষ্ট রচনা এবং দূরত্ব পরিমাপ প্রদান করবে ।

তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/ , https://www.nasa.gov/ , https://hubblesite.org/ , অন্তর্জাল (The Internet) । 
ছবি: https://www.wikidata.org/

1 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. ঈদ মোবারক!
    পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা ।
    আমার লেখাটি "মহাকাশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ও দূরবর্তী নক্ষত্র Earendel" প্রকাশিত হওয়ায় পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ।

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।