ভাষা আন্দোলন ।। আফছানা খানম অথৈ

ভাষা আন্দোলনঃ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহি:প্রকাশ ঘটে।১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চুড়ান্ত রুপধারণ করলেও এর বীজ যাপিত হয়েছিল বহু আগে।অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বৃটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ,পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় ২০০০ কিলোমিটারের অধিক দুরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল।১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন যে,"উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা"।

পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবী হরপে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবী করার ও প্রস্তাব দেওয়া হয়।আবার সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাব ও করা হয়।
এ সকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগনের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়,ও বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি।যার ফলস্বরুপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবীতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে উঠে।আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ দ্বারা জারি করে।ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ,ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে।মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দীলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করে।গুলিতে নিহত হন,রফিক,সালাম,বরকত,আব্দুল জব্বারসহ নাম না জানা আর ও অনেকে।
এছাড়াও ১৭ জন ছাত্র যুবক আহত হয়।শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে।২২ ও ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র,শ্রমিক,সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে, এবং সভাশোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে।২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক,রিক্সাচালক আউয়াল,ও অলি উল্যাহ নামক এক কিশোর।২৩ শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র জনতার মিছিলে ও পুলিশ অত্যাচার নিপীড়ন চালায়।

এ নির্লজ্জ পাশবিক পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিমলীগ সেদিন সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন।ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার।যা ২৪ শে ফেব্রুয়ারি উদ্ভোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।২৬ শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্ভোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতী স্বীকার করতে বাধ্য হন।এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অণুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়।সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলাভাষা প্রচলন আইনজারী করে।১৯৯৯ সালে ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাভাষা আন্দোলন,মানুষের ভাষা, কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।

( ভাষা আন্দোলন ।।  আফছানা খানম অথৈ) 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।