মা, মনে আছে তোমার? আজ কিন্তু সকালে আমরা শুধু পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা খাবো না। তুমি যতোক্ষণ না আসো আমরা অপেক্ষা করবো। ভাইকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলল মুন্নী। ওর ছোট ভাই রতনও খুশি হয়ে বলল, মা, তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে। আমার যে ক্ষুধা লাগে। মা সবকিছু গুছিয়ে বলল, আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। তোমরা লক্ষী হয়ে থেকো। এই মুন্নী ভাইকে দেখে রাখিস। আবার পাড়া বেড়াস না যেন। আমি পান্তা ভাত, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর আলু ভর্তা সব ঠিক করে রেখেছি। দিদিকে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসব। তারপর আমরা তিনজনে একসাথে খাব আর নববর্ষ উদযাপন করব। চলি রে মা।
মুন্নীর মা ওদের বস্তীর পাশে একটা বিল্ডিং এ একজনের বাসায় কাজ করে। মুন্নী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া করে নি। রতন এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওর বাবা আর একটা বিয়ে করে শহরে থাকে। এদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। মুন্নীর মা অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়ে দুটো নিয়ে এই বস্তীতে দিনযাপন করছে। মেয়েকে সামনের মাস থেকে একটা গার্মেন্টস এ চাকরির জন্য দিয়ে দেবে। ওদের বস্তীর অনেক মেয়ে, বউ, মাসীরা চাকরি করে। মালতী মাসী যেখানে চাকরি করে সেখানে মুন্নীর জন্য চাকরি ঠিক করে রেখেছে।
মুন্নীর মা, আজ আমাদের বাসায় আমার মেয়ের বন্ধুরা আসবে। তুমি দুইটা ইলিশ মাছ ভালো করে কেটে ধুয়ে টুকরো করে রাখ। আমি ভেজে নেব। কথাগুলো বলে ভদ্রমহিলা উনার রুমে চলে গেল। মুন্নীর মা মাছগুলো কেটে, ধুয়ে তৈরি করে রাখল। তারপর দুপুরের রান্নার জন্য সব মসলা বাটতে বসল। ঐ বাসার ছেলেমেয়েরা কিছুক্ষণ আগে পাউরুটি, মিষ্টি, নুডুলস, এসব নাস্তা কিছু খেল আর কিছু নষ্ট করল। নষ্ট করা খাবার গুলো মুন্নীর মা যত্ন করে ছেলে মেয়ের জন্য নিয়ে নিল। ভদ্রমহিলা এসে মাছগুলো ভেজে নিল। তারপর দুপুরে মাংস, চিংড়ি মাছের মালাই কারি, কাতলা মাছের কালিয়া আর ডিম ভুনা করার জন্য সব তৈরি করে নিল। মুন্নীর মা সব কেটে, বাটনা বেটে বলল, দিদি, এখন আমি যাই। ভদ্রমহিলা রান্না করতে করতে বলল, আর একটু পরে যেয়ো। ওরা পান্তা ইলিশ খেতে বসেছে। ওগুলো ধুয়ে তারপর যেয়ো। আমি তোমার জন্য পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা আর কালকের বাসী তরকারি এখানে রেখেছি। যাওয়ার সময় নিয়ে যেও। মুন্নীর মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু ওর চিন্তা বেড়ে গেল। ছেলে মেয়ে দুটো না খেয়ে ওর পথ চেয়ে বসে আছে। এরা তো সব বন্ধুরা মিলে গল্প করতে করতে খাচ্ছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
রতন পথের দিকে তাকিয়ে আছে কখন মা আসবে। মুন্নী বলল, ভাই ঘরে মুড়ি আছে দুটো খেয়ে নে। মায়ের হয়তো কাজ বেশি করতে হচ্ছে তাই দেরি হচ্ছে। রতন মুখ গোমড়া করে বলল, না খাব না। মাকে এতো করে বললাম তাড়াতাড়ি এসো। মা তবু কেন দেরি করছে। মুন্নী ভাইকে আদর করে বলল, ভাই, মন খারাপ করিস না। মা পরের বাসায় কাজ করে। তাই ওদের ইচ্ছে মতো চলতে হয়। শোন আমি তো এখন চাকরি করব। সামনের বছর থেকে আর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি তোর জন্য ইলিশ মাছ কিনে আনব। তখন একটা বড় টুকরা তোকে পান্তা ভাত দিয়ে খেতে দেব। ঐটা শুনে রতন খুশি হয়ে বলল, সত্যি বলছিস দিদি। আমি এক টুকরো খেতে পাবো? রতন দিদিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে নাচতে লাগলো। মুন্নী ভাইয়ের এমন আনন্দ দেখে ওর চোখে জল চলে এলো। মুন্নী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ রে, সত্যি ভাই। রতন চিৎকার করে বলে উঠলো, এই দিদি, দেখ, মা আসছে। তারপর ওরা ঘরে গিয়ে সবাই একসাথে খেতে বসল। তখন প্রায় দুপুর হয়ে আসছে। মা ঘরের পান্তা ভাতের সাথে ঐ বাসা থেকে আনা ভাত একসাথে করে তিনজনের জন্য বেড়ে নিলো। তারপর আলুভর্তা, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ নিলো। এবার ইলিশ মাছের টুকরা তিন ভাগ করলো। গতকালের বাসী মুরগির মাংসের ঘিলা, কলিজা আর ছোট দুই এক টুকরো মাংস, আলু এগুলো দিলো। রতন খেতে খেতে বলল, আহ্ কি মজা ইলিশ মাছ! জানো মা, দিদি বলেছে, সামনের বছর আমি এক টুকরো ইলিশ মাছ খেতে পারব। দিদি চাকরি করে আনবে। মায়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। তারপর হেসে বলল, ও তো ঠিক বলেছে। এই দেখ, তোদের জন্য মিষ্টি এনেছি। মুন্নী বলল, এগুলো এতো ভাঙা কেন? মা বলল, সব একসাথে নেওয়ায় ভেঙে গেছে। ওরা দুই ভাই বোন তৃপ্তি সহকারে খেলো। রতন বলল, আর দুপুরে খেতে হবে না মা, পেট ভরে গেছে। আর কিছু এনেছো মা? মা বলল, বিকেলে পাউরুটি আর নুডুলস খেতে পারবি। এগুলো এনেছি।
প্রতিদিন মুন্নীর মা দুপুর পর্যন্ত কাজ করে দুপুরে ওর জন্য দেওয়া খাবার এনে তিনজনে ভাগ করে খায়। কিন্তু কোন পূজা পার্বণ হলে দুপুরের আগে চলে আসে।
আজ নববর্ষের দিনে ওরা এক টুকরো ইলিশ মাছের জন্য অপেক্ষা, এরপর তিনজনে মিলে সেই টুকরো ভাগ করে খেয়ে যে তৃপ্তি পেল তা হয়তো কোন ধনীর ঘরেও পাওয়া যায় না।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
নাম: জোনাকী দত্ত।
পেশা: শিক্ষিকা।
জেলা: চট্টগ্রাম।