মেঘ বর্ষায় রবীন্দ্র কলতান ।। ফারজানা অনন্যা


বাংলা মায়ের ছয়টি কন্যার মধ্যে সবচাইতে সজীব, সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুহিতার নাম "বর্ষাসুন্দরী"। বর্ষার বাঁধভাঙা জোয়ারে প্লাবিত হয় প্রকৃতি। মানব মনে জাগে প্রণয়, বিরহ ও স্মৃতিকাতরতার অঝোর ধারা। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতায় লাল ফুলের আড়ালে টিয়ার বৃষ্টিস্নান, কার্ণিশে জোড়া কবুতরের কথোপকথন! দূর পাহাড়ের মাথায় জমতে থাকা মেঘবালিকারা ঝরতে থাকে মাঠ-ঘাট-উঠানে। তখন হৃদয়ও নেচে ওঠে অজানা শিহরণে। 

প্রকৃতির সৌন্দর্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবলোকন করেছেন নেত্রদ্বয়ে, ধারণ করেছেন হৃদয়ে আর লেখনীর দ্বারা ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন বিশ্বময়! তিনিই আমাদের দেখিয়েছেন বাংলার প্রকৃতিতে ছয় ঋতুর বর্ণাঢ্যতা তুমুল রাজসিক ও বৈচিত্র্যময়। তাঁর কথা, কবিতা ও গান প্রকৃতির নান্দনিকতাকে নানাভাবে উপস্থাপন করে। কবিগুরুর প্রকৃতিলগ্ন এই সৃষ্টিকর্ম পরিমাণের দিক থেকেও সমুদ্রসম।  

আমাদের সব ঋতুর বর্ণ-গন্ধ আলাদা।

সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য জুড়ে বর্ষার ঘনঘটা যেন নীল শাড়ি পরিহিতা এক চঞ্চলা চির নবীনা নন্দিনীর মতো। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বর্ষাসুন্দরীর বহিঃপ্রকাশ অনির্বচনীয় কবিত্বে, মানবহৃদয়ের আবেগ প্রকাশের চিরকালীন ভাষায়। সাহিত্যের নানা শাখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসম্ভারে বর্ষার রূপ, রস, প্রভাব ফুটে উঠেছে নানা রঙে, ঢঙে , বৈচিত্রময়তায়! "ক্ষণিকা" কাব্যগ্রন্থের 'আষাঢ়’  কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বর্ষার অনবদ্য চিত্রণ ঘটিয়েছেন এভাবে :

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।/
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে বর্ষাকে শুধু একটা ঋতু হিসেবে দেখেননি, বরং কালিদাসের মতো মানবজীবনে বর্ষার চিরায়ত প্রভাবও তুলে ধরেছেন। প্রবল বর্ষণে হারানো অতীত মনের পটে ছবি আঁকে। বৃষ্টির অবিরল ধারায় জীবনের চিরায়ত বিচ্ছেদের সুর অনুরণিত হয়। মনে হয়, আড়ালে ভালো লাগা, ভালোবাসা,  হৃদয়ের কাছাকাছি সবচাইতে আপন মানুষটিকে না বলা অব্যক্ত কথাটি বলে ফেলা যায় এই বৃষ্টিস্নানে খুব সহজেই! "মানসী" কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষার দিনে' কবিতার ভাষায়:

"এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার-
জগতে কেহ যেন নাহি আর।"

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য গানের ছত্রে ছত্রে ঝতুরাণী বর্ষা ধরা দিয়েছে স্নিগ্ধ, শ্যামল, সুন্দর রূপে! ঋতু বৈচিত্রের ভিত্তিতে "গীত বিতান" গ্রন্থে মোট ১১৫ টি বর্ষার গান আছে। বিশ্বকবি বর্ষার জলধারাকে 'শান্তির বারি' রূপে সম্বোধন করেছেন! তাঁর গানে শান্তির ধারা বর্ষণ ধুয়ে মুছে দিয়ে যায় মানবজীবনের যত স্খলন-পতন-ত্রুটি! 

"না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোকপরিতাপ।
হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি।
বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি"

বর্ষাসুন্দরীকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষার প্রসাধনী আর অলংকার দিয়ে সাজিয়েছেন কখনো রাণী, কখনো সতেজ নারী, তখনো নম্র প্রেমিকা কিংবা কখনো চঞ্চলা বালিকা রূপে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে  বর্ষার ধূসর মেঘকে তুলনা করেছেন প্রিয়ার ঘন কালো কাজলের সাথে। 

"হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সেই সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে"

নবধারা জলে প্রিয় মানসীর সাথে সুন্দর সময় অতিবাহিত করার নিদারুণ আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর একটি চমৎকার গানে।

"এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে,   
এসো করো স্নান নবধারাজলে॥
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,   
পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ-
কাজলনয়নে, যূথীমালা গলে,   
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে।"

গীতবিতানের পাতায় পাতায় বর্ষা আসে সৌরভে, বর্ষা আসে বিরহে। এতেই বোঝা যায়, কবির প্রিয় ঋতু হচ্ছে বর্ষা। 

‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানি নে জানি নে 
কিছুতে কেন যে মন লাগে না।"

রবীন্দ্রনাথের এ গানটি প্রেমিকের মন উচাটন করে তোলে; বিরহী করে তোলে। সঙ্গীর সান্নিধ্য পেতে মাতাল হৃদয় মরিয়া হয়ে ওঠে।

বসন্ত ঋতু ঋতুরাজ বলে কথিত হলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষাই যেন ছিলো ঋতুরাজ। একদা অতি শৈশবে বৃষ্টির সেই যে বিশেষ তাল, লয় আর ছন্দের পতন, আর তার সঙ্গে তরুলতার পাতার বর্ণিল ছন্দময় নড়ে ওঠা শিশু কবির মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আজন্ম বন্ধনে কবিকে বেঁধে ফেলেছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ "জীবনস্মৃতি"

তে  নিজেই বলেছেন যে ,জীবনের  এক একটা পর্যায়ে এক একটা ঋতু বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে, সেই হিসেবে বাল্যকালের উপর বর্ষা ঋতুর প্রভাব লক্ষণীয় । কবি বলেন,

"বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেগে জলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটা বড় ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাদা ভাঙ্গিয়া আসিতেছে, আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে ছুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরজায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাশ বসিয়াছে ; "

পোস্টমাস্টার’ গল্পে বর্ষার পল্লীবাংলার নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে প্রাঞ্জল ভঙ্গিমায়। শ্রাবণের মধুর বর্ষণে ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল এই গল্পের মোহনীয় শব্দগুলো।

"শ্রাবণ মাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ—নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।"

বর্ষার এমন অনেক অনবদ্য বর্ণনায় সমৃদ্ধ এই গল্প। শুধু পোস্টমাস্টারই নয়, বর্ষাবিষয়ক গল্পের তালিকায় আরো আছে 'একরাত্রি', 'ছুটি', 'জীবিত ও মৃত' ইত্যাদি। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ব্ষাবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'মেঘলা দিনে', 'বাণী', 'মেঘদূত', 'বর্ষা ও শরৎ', 'বর্ষার চিঠি', 'বৈশাখী ঝড়ের সন্ধ্যা', 'আষাঢ়', 'বসন্ত ও বর্ষা', 'নববর্ষা' ইত্যাদি। কবি গুরুর বর্ষার সমগ্র আয়োজনকে আরো ঋদ্ধ করেছে এ বিষয়ক কিছু চিঠিপত্র। তাতে বর্ষার নানা দিক উঠে এসেছে। বর্ষাবিষয়ক প্রায় ১৬টি চিঠির মধ্যে একটি হেমেন্দ্রবালা দেবীকে লেখা। 

রবীন্দ্রনাথের সমুদ্রসম রচনা-নিচয়ের বিশাল অংশজুড়ে আছে বর্ষা, যার খুব সামান্যই এখানে বিবৃত হলো। তাঁর বর্ষার কোমল শব্দমালা থেকে যদি আমাদের হূদয়কে আর্দ্র করতে হয় তাহলে আরো গভীর পাঠ ও অনুসন্ধান প্রয়োজন। সেই চেষ্টা আমাদের করতে হবে। বর্ষার আশ্চর্য মেঘদল আমাদের জীবনে শান্তির বারতা ছড়িয়ে দিক।

ফারজানা অনন্যা
প্রভাষক
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।