ভালোবাসা, বিশ্বাস আজকাল খুব সস্তা হয়ে গিয়েছে। তাই এই সকল বিষয়গুলোকে আজকাল জীবনে স্থান দেওয়া বোকামি। আমি আজ এমনি একটা ঘটনা বলতে চলেছি আমার জীবনের। সালটা ছিলো ২০১৯ এর ২৪সে নভেম্বর। একটা ছেলে, নাম কৌসিক, জন্মদিনের বার্তা পাঠাই তাকে ফেসবুকে। খুশি হয়ে সেও ধন্যবাদ জানায়। বয়স আঠেরো। আমি ছেচল্লিশ। প্রথমে স্যার বলে সম্বোধন করতো। একটু আলাপ হতেই স্যার থেকে বলতে বললাম কাকু। প্রতিদিন ফোন। বাদ যায় না একদিনও। সকাল হলেই সুপ্রভাত কাকু। আলাপ এমন জমে উঠলো, যেন নিজের রক্তের সম্পর্ক। ক্রমশ জানতে পারি, ছেলেটা ভালো মাউথঅরগান বাজায়। সঙ্গে মেলোডিকা।
গান বাজনা ভালো বাসি, তাই আমিও খুব আকৃষ্ট হয়ে গেলাম তার প্রতি। আমার লেখা কবিতা ওর খুব ভালো লাগতো। তার আদান প্রদান করতে এক মধুর সম্পর্ক। একদিন জানতে পারে, আমি অভিনয় জগতের সঙ্গেও যুক্ত। ২০২০ সালে, সে আমার কাছ থেকে কিছু গল্প নিয়ে ছোট ছবি করলো। সেই বছর আগস্ট মাসে, আমাকে বলল, একটা ছোট ছবি করবে, আমাকে অভিনয় করতে হবে। যেতে হবে ওদের বাড়ি রায়দীঘিতে। ভালোবাসার টানে চলেও গেলাম। তখন পৃথিবী জুড়ে চলছে মহামারীর তাণ্ডব। অন্যদিকে এক পরিচালকের সাথেও আমি কাজ করছি পলাশীতে। তিনি একটা নতুন মুখ চাইছিলেন ভিলেন চরিত্রের জন্য। কলকাতা থেকে একজনকে ঠিক করলাম আমি। আর কৌসিক দ্বিতীয় ভিলেন। কিন্তু প্রথম ভাগের শুটিং শেষে কলকাতার ছেলেটার সাথে মতানৈক্য হতে, কৌসিককে, সেই স্থানে বসিয়ে কাজ শেষ হলো। সেও আমার সুপারিশে। এর মধ্যা ওর বাড়িতে প্রায় দু’তিন বার যাওয়া হয়ে গিয়েছে।
কলকাতায় আরো একটা হাউসে আলাপ করিয়ে দিলাম ওকে। সেখানেও আমি অভিনয় করছি, পরিচালক আমার দিকে তাকিয়ে, ওকেও নিয়ে নিলো। কিন্তু অভিনয়ে কাঁচা বলে কিছু টাকা দাবি করে বসলো। আমি শুনে প্রথমে না করলাম। কিন্তু ওর জ্ঞো আর ইচ্ছে দেখে রাজি হলাম। পলাশীর হাউসে আমি ছিলাম এক গুরুত্বপূর্ণ পদে। তাই আমার কথার একটা দাম ছিলো। সেই জায়গা বাবু নিতে চাইতে আরম্ভ করলেন তলে তলে। আমার সঙ্গে পলাশীর পরিচালকের কোন বিষয়ে মত বিরোধ হলে, কাকে আর বলবো, ওকে বলতাম। তিনি করতেন কি, ফোনে রেকর্ডিং করে পলাশীর পরিচালককে ফরওয়ার্ড করে দিতেন। এবং আমার কাছে ভালো সাজতেন। আমি সাধা সিধা মানুষ, জটিলতা বুঝতে পারতাম না। ঠিক একই ভাবে কলকাতার হাউসেও উনি আমার নামে নানা অকথা কুকথা বলতো।
ছেলেটা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সুযোগ পেয়েছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। রায়দীঘি থেকে সে চলে আসলো তার দিদিমার কাছে। মাতৃস্নেহে রেখেছিলো তাকে। এক বছর যেতে না যেতেই একদিন পলাশী যাবার পথে জানায়, সে সেই শিক্ষালয় ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে, আমাদের তখন দ্বিতীয় ছবি শুরু হয়েছে। কৌসিক নায়ক। ছবিতে কাজ করছে আরো দু’তিন জন নামকরা শিল্পী। আমি তো ছিলাম। কলকাতার পরিচালকের পরিচালনায় কাজ করছে ছেলে। তিনি আমায় জানালেন, কৌসিকের জন্য একটা ভালো চরিত্র দিয়েছে। ওর ভবিষ্যৎ পথ ভালোর দিকে এগোবে। আমার মতন কোন ভূমিকা ছিলো না, তাই আমি বাদ।
এসবের সাথে টলিগঞ্জের এক ক-অরডিনেটরের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিলাম। সেখান থেকেও সে কাজ পায়। এবং আয়ও করে। বলা বাহুল্য, কলকাতার পরিচালকের কাছ থেকে, ছেলে কিছু টাকা আয়ও করেছিলো। ২০২১ পেরিয়ে এলো ২০২২। আমার সঙ্গে তার সম্প্রর্ক খুবই স্বচ্ছল। পলাশীর পরিচালক আমাকে বলল, ওকে একটু কম গুরুত্ব দিতে। পলাশীতে দ্বিতীয় ছবি করার সময় আমাদের আলাপ হলো আরেক নবাগত আভিনেতা সাগর চক্রবর্তীর সাথে। ত্রিপুরার ছেলে সে। সে এই শিল্পতে আসতে অনেক টাকা ঢেলেছে। কিন্তু কোন ফল পায় নি। তার ইচ্ছে সে একটা অভিনয় শেখানোর সংস্থা খুলবে। তার অনেক প্রযোজক ও পরিচালকের সাথে আলাপ আছে। সেও আমাকে ও কৌসিক দুজনকে পলাশীর পরিচালকের বিরুদ্ধাচরণ করতে বলে। আমি সায় দিয়েছিলাম প্রথমে কাজ পাওয়ার জন্য। একবার শুটিং করতে আসার পথে আমাকে এমন কিছু অসন্তোষ সুলভ কথা বললে, তখন তার অভিপ্রায় বুঝতে বাঁকি রইলো না। কৌসিক সাগরকে দাদা দাদা বলে ওকে হাত করতে শুরু করছিলো। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা হলো, ওদের সেই বন্ধন ভেঙে গেলো।
এদিকে ২০২২ সালের গোড়ার দিকে কলকাতার পরিচালকের ছবি মুক্তি পাবে, আমাকে কৌসিক জানালো, তার ছবি না আছে ট্রেলারে না আছে পোষ্টারে। আমি বললাম, ছবি থেকে সে তো বাদ যায় নি। প্রথম দিন গেলাম দেখতে। ভুতের ছবি। ছবি দেখে তার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। বলা বাহুল্য, কৌসিকের ভুমিকা গুরুত্বহীন বলে মনে হলো। আমি নিজে গেলাম ক্ষেপে। বললাম, এদের সঙ্গে আর যদি কোন কাজ করো তাহলে, আমার সঙ্গে তোমার এই সম্পর্ক থাকবে না। তাদের বাড়িতে গিয়েও তার বাবা মায়ের সামনে এই কথা বললাম। এতে বাবুর রাগ হলো। ভাবল, আমি বোধহয় ওর পাকা ধানে মই দিচ্ছি। সে এই নিয়ে পলাশীপাড়ার পরিচালককে আমার এই কাণ্ডের অভিযোগ করলে। সেও চুপ করে রইলো।
ইতিমধ্যে সে মধ্যমগ্রামে নাচের তালিম নেওয়া শুরু করেছে কৌসিক। বাড়িতে দিদিমার সঙ্গে অশান্তির কথাও বলে। একদিন শুনলাম, সে নিজের বাড়ি রায়দীঘি ফিরে যাচ্ছে। ইতি মধ্যে পলাশী পাড়ার পরিচালকের তৈরী করা ছবি প্রকাশ পেলো। কলকাতার ধর্মতলা, টালিগঞ্জ, রানিকুঠী এবং তৎসহ যে যে অঞ্চলের ছবিঘরে এই ছবি দেখানোর সুযোগ পেয়েছি, সেই অঞ্চলেও তার পোষ্টার লাগানো হয়েছে। ইউ টিউবে ট্রেলার, ট্রেলারে তাকে রাখা হয়েছে। এত কিছু করার পরও তার মন গলল না। নতুন প্রযোজক পেয়ে নতুন সিনেমার কাজ শুরু হলো ফের। যদিও এই ছবিতে তার উপযুক্ত চরিত্র ছিলো না। কিন্তু পরিচালক ভাই, একটা চরিত্র করার জন্য তাকে বলতে, সে নাকোচ করলো। বললে, অতো ছোট চরিত্রে অভিনয় করবে না। আমিও তেমন পাঠ পাই নি। কিন্তু আমি থেমে থাকি নি।
ইতি মধ্যে কলকাতার পরিচালক মহাশয়, একটা নতুন ছায়াছবি শুরু করতে চলেছে, শুনলাম। কৌসিকের আবার সেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। শুটিং হবে বর্ধমানে। আমি শুনে একটু সন্দেহ প্রকাশ করলাম। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। একদিন দেখি ভোর সাড়ে চারটের সময় আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে তারপর আমার মেসেজ পড়লেন প্রায় রাতের দিকে। আমি জানতে চাইলাম কোথায়, বললে বর্ধমানে গিয়েছে শুটিং করতে। পরে কলকাতায় ফিরে এসে, ফোন করতে সে জানায়, শুটিং স্পট থেকে সে চলে এসেছে। কারণ তাকে যা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তার প্রতি সিনে ভূমিকা আছে। কিন্তু দিন চারেকের মধ্যে একটা সিনে তাকে রাখা হয় এবং তাকে প্রডাকশনের কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সে কিছু ছোট বাচ্চাদের দিয়েছিলো, কিন্তু টাকার অভাবে কাজও মাঝে বন্ধ হয়ে যায়, এবং যাদের কাজ করিয়েছে, তাদের কোন পারিশ্রমিকও পরিচালক না দেওয়ার জন্য সে ক্ষুব্ধ। তাই সে চলে এসেছে।
আরো একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়, বীরাটির একটা হাউসে যাবার আনুরোধ করে কৌসিক। সেই হাঊসে আমি পূর্বেই ঘুরে এসেছি। তার সাথে অডিশনে দেখেই সেখানকার ম্যাডাম বললেন, আপনি তো এসেছিলেন। কৌসিকের কাজ দেখে ওদের নতুন একটা ফিল্মে ওকে হিরোর বন্ধুর ভূমিকায় ওকে ডাকল। তারপর জানালো, সেই ভূমিকাও খুবই ছোট, তাই সে করবে না। ইতিমধ্যে আমাকেও ডাকলো একদিন। শুনলাম এই ভূমিকা ছিলো এক দিদিমার। নাম ভূমিকায় ছিলো বিশিষ্ট অভিনেত্রী অনামিকা সাহা। কিন্তু এখানে করতে হবে আমাকে, দাদু চরিত্রে। আমি এখানে নতুন। তাকে জানাতে বলল, সে জানে, এই চরিত্র খুব একটা বড় নয়। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখলাম চরিত্রের গুরুত্ব আছে। কিন্তু কাজে গিয়ে দেখলাম, কাজের ব্যাপ্তি আছে। আরো জানলাম, বাবুকে যে চরিত্রের জন্য বলা হয়েছিলো, সেই চরিত্রের ওয়ার্কশপে, সে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই তাকে পরে আর ডাকে নি।
কৌসিক কোলকাতায় থাকার জন্য চেষ্টা করেছিলো। আমাকেও বলেছিল। আমার বাড়িতে থাকার জায়গার অভাব নেই, কিন্তু বাড়িতে বুড়ো বাবা মা। আর আমার মা বাবা আমার কোন প্রিয়জন বাড়িতে আসে, সেটা কোন দিনই পছন্দ করতো না। এক রাত্রির জন্য কেউ এলেও দেখেছি অসন্তুষ্ট হতে। তাই যদিও কেউ আসে, তার খাবারের ব্যবস্থা আমি বাইরে থেকে করে আসি। একদিন ছেলে আসবে বলে বাড়িতে মাকে বলতে, মায়ের প্রতিক্রিয়া আমি রেকর্ড করে শুনিয়েছিলাম। তার পরেও সে ভাবল, আমি বোধহয় ইচ্ছে করে তাকে আশ্রয় দিই নি। অনেককে সে এই কথা বলেছে। সেটাও আমি জেনেছি তাদের কাছ থেকে। তবু তাকে ফেলে দেবার কথা আমি ভাবতে পারি নি। ভালো মন্দ দিতে না পারলেও, সঙ্গ দেবার চেষ্টা করেছি।
তার সাথে একদিন অন্তরঙ্গ কথা বলে জানলাম, তার বাসনা সে সিনেমা পরিচালনা করবে। এবং তার প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। আমাকে একটা চরিত্র করতে হবে তাতে। কিছুদিন পর সে জানালো, যারা এই ছবিটা প্রযোজনা করছে, তারা তাদের লোক দিয়ে করাবে। আমরা সকলে বাদ। বাস্তব হলো, সাগর চক্রবর্তী, আমাকে সেই চরিত্র থেকে সরিয়ে, নিজে সেই ভূমিকায় কাজ করলো। যদিও পরে দেখলাম, ছবিটা যারা করেছে, সকলেই ছোট এবং নবাগত। ছবিটাতে বেশ কিছু ভুল ছিলো, ওর যাতে ভালো হয়, তাই ওকে সেই ভুলগুলো বলতে আমি, সে ভাবলো, আমি ওর খারাপ চাই। সেই নিয়েও অনেককে আমার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এর পর ও একদিন দেখি একটা ছবি করবে বলে পোস্টার দিয়েছে। নাম “গান ভিখারি”। আমি জিজ্ঞেস করলাম কে কে করছে। আমাকে বললো ঠিক হয় নি। একদিন দুপুর বেলা, বিশ্রাম নিচ্ছি, আমাকে ফোনে বললে, গান ভিক্ষারিতে তুমি করবে? আমি না বললাম না। নির্দিষ্ট দিনে গেলাম, করলাম। এর জন্য ও আমাকে আটশো টাকা দেবে বললো। ভাবলাম, ওই ছোট্ট ছেলেটার কাছ থেকে টাকা নেবো, এতদিন তো আমাকে ভুল ভেবে এসেছে। আমাকে পাঁচশো টাকা আমাকে দিয়েছিলো, সেটা ফেরত দিয়ে দিলাম। বললাম, আমার যাতায়াত ভাড়াটুকু দিলেই হবে।
সেদিন ওর বাড়িতে যখন গেলাম, আমাদের সাথে একটা বাচ্ছা মেয়ে অভিনয় করেছিল, তার আর তার বাবার প্রতি আদর যত্ন দেখলাম তুঙ্গে কিন্তু, আমি যে এসেছি, তার কোন ভাবই পেলাম না। ঠিক করলাম, সেইদিন ফিরে যাবো। ওদের বাড়িতে একটা সিন শেষ করতে প্রায় সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেলো। সেদিন দুপুরে কেউ বললো না পর্যন্ত, তুমি তো সবই জানো। নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও। মনে মনে ভীষণ অপমান বোধ হলো। পরের দিন রাত তিনটের সময় উঠে রওনা দিলাম বাড়ির ঊদ্দেশ্যে। এর পর কিছুদিন পর ফোন করতে দমদম বিমান বন্দরের খোঁজ করছে। কারণ জিজ্ঞ্যেস করতে বলল, এমনি। পরদিন ফেসবুকে দেখলাম, বাবু বিমানে করে কোথায় চলেছে। বলে অজানা দেশে। পরে বলল, আসামে। সেখানকার আমার এক পুত্র তুল্য ছেলে আছে, বিপ্লব। সে জানালো, আসামবাসী নিজেরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, সেইখানে বাংলা থেকে লোক এসে সিনেমার ব্যবসা খুলবে, এটা হতে পারে না। মাস খানেক পর বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব। পুজোর সময়ে সে সেখানেই ছিলো।
কিছুদিন পর, পলাশীর পরিচালক ছেলেটা আমাকে একটা লিঙ্ক দিলো। খুলে দেখলাম একটা নতুন অভিনেতা ও অভিনেত্রীর সুযোগ দানের বিজ্ঞাপন। শুনলাম কৌসিকের কণ্ঠস্বর। সংস্থাটা ত্রিপুরার বারদৌলিতে। সন্ধান লাগিয়ে অনেক তথ্য পরিষ্কার হলো। এদিকে পলাশীর পরিচালক ঘোষণা করলো আমাদের নতুন ছবির। মুখ্য চরিত্রে কৌসিক। ইতিমধ্যে “গান ভিখারি” মুক্তি পেলো ইউ টিউবে”। স্বনাম ধন্য অভিনেতা আমার ভূমিকা দেখে আমাকে ফোন করে প্রশংসাবাদ দিয়ে কৌসিকের নম্বর চাইলো। আমিও সেদিন কোন বিবেচনা না করে, ওর নম্বর দিয়ে দিলাম আর কৌসিককে সেই অভিনেতার নম্বর। আমাকে বিশ্বাস করে দিয়েছিলো পলাশীর পরিচালক। আমি ওকে বলতে খুব রেগে গেলো। বলল, এই মাপের শিল্পীদের নম্বর কতো কষ্ট করে যোগার করতে হয়, তবে তাদের নিয়ে কাজ করা যায়।
মনে পরে গেলো, আমার জীবনের একটা ঘটনা। একজন পরিচালক আমার কাছ থেকে টোটা রায়চৌধুরীর নম্বর চেয়েছিলো, তখন আমি এম. পি. জুয়েলার্সের কর্মচারী। আমার সিনিয়ারও দেয় নি। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য। মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিলো। পুজো কেটে গেলো। পুজোর পর আমাদের নতুন ছবির কাজ শুরু হবে। কৌসিকের সাথে আমি যোগাযগ করলাম। বলল শুটিং হবার দুদিন আগে ট্রেন পথে আসবে। নির্দিষ্ট দিনে আমরা সকলে উপস্থিত হলাম আমাদের শুটিং স্পটে। আসার দিন কৌসিকের মা বাবা আমাকে আর পরিচালক ভাইকে দিন চারেক জানালো তাদের ছেলে আসছে। আমাদের মধ্যে ছিলো ইন্দ্র। “দুর্বা” নামক প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে ওর সাথে খুব হৃদ্যতা করে। কাজের কালে ইন্দ্র কৌসিকেক খুবই সাহায্য করে। স্পট দেখে দেওয়া, খাবার শিল্পীদের থাকার সব রকম সাহায্য করে। তার সাথেও সে তেমনই ব্যবহার করে। ইন্দ্র নিজেও একটু অপ্রস্তুত ছিলো তার আসাকে ঘিরে। আমি আর পরিচালক ওকে বললাম, বেশি কাছে না যেতে। সেদিন রাত্রে বাবু এলেন প্রায় সাড়ে বারোটা। আমি আর বিশ্বজিত দুজনে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। আসতেই তাকে খেতে দিলাম। বিছানা পেতে দিলাম। ভোর হতেই শুটিং শুরু হলো। বাসে করে গিয়ে পৌছলাম শুটিং স্পটে।
আমার প্রথম একটা সিন। আর নেই তেমন। মেক আপ করে রেডি। তবে শুটিং স্পটে আমাকে কিছু কাজ সামলাতে হয় বলে, প্রথম টেকে করে বসলাম কিছু ভুল। ডায়লগ দিতে গিয়ে একটু ভাষাগত সমস্যা হলো। সমস্যাটা ছিলো অন্য। যে ভাবে সিনটা হওয়া উচিত ছিলো, সে ভাবে সিনটা হচ্ছিলো না। আমার মনের মধ্যে একটা বিরক্তি ভাবো হচ্ছিলো। সেই কারণে আমার পজিশন নিতে পারছিলাম না। পরে আমি নিজের মতো করে সাজিয়ে করতে বিষয়টা ঠিক হলো। কিন্তু কৌশিক সেদিন পরিচালকের কাছে গিয়ে বলে, আমাকে কেন এই রোলটা দেওয়া হয়েছে? এবং সেও নানা ভাবে আমাকে টোন কাটতেও শুরু করে। আমি এই ঘটনার পর চুপ হয়ে গেলাম। পরের দিন সকালেও তার কাছ থেকে একই ব্যবহার পেলাম। মনে মনে একটু অসন্তুষ্ঠও হলাম। শুধু তাই নয়, তার ‘গান ভিক্ষারি’ শর্ট ফিল্মে আমাকে কাজ করিয়েছে বলে বার পঞ্চাশেক বলেছে। আমি তাও চুপ করে রইলাম। ফেরার দিন পাশে বসে, একসাথে শিয়ালদহ পর্যন্ত এলাম। আদর করে জড়িয়ে তাকে বিদায়ও দিলাম।
এর কিছুদিন পর ফেস বুকে দেখি সেই গান ভিক্ষারি করার পর যে অভিনেতা ফোন নম্বর চেয়েছিলো তার সাথে ছবি। দেখে তো চক্ষু চড়ক গাছ। আমরা লোকটার সাথে কথা বলতে দু’বার চিন্তা করি। সে নিজের স্বার্থেই হোক আর ব্যবসায়িক স্বার্থে আর ভালবাসার জন্যই হোক। সে ছেলে চলে গেল তার বাড়ি। ঠিক তার পরের দিন আমাদের পলাশী পাড়ার পরিচালক, পুজোর সময়ের জনগণের কাছ থেকে কিছু প্রিভিউ নিয়েছিলাম,তার একটা ভিডিও পোস্ট করেন। সেই ইন্টারভিউটা আমি নিয়েছিলাম। আর যে ইন্টারভিউ দিয়েছিলো, সে সত্যজিৎ রায়ের ছবির সাথে আমাদের ছবির তুলনামূলক কথা বলেছিলেন। সেই দেখে কৌশিক বাবু আমাকে ফোন করে বিদ্রূপের সাথে বলতে শুরু করে। সেইদিন আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আগুনের মতো ছিটকে পড়লাম ওর ওপরে। তার সাথে সেই স্বনাম ধন্যা শিল্পীর বাড়িতে গিয়ে নানা কথা হয়েছে বলতেই আমি গর্জে উঠলাম। দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর, মুখ খুললাম আমি।
ফোন শেষ করেই জানালাম আমার পলাশী পাড়ার পরিচালককে। পরের দিন সেখানে আমার যাওয়ার কথা। কার্যক্রম অনুযায়ী ওখানে যাই আমি। সেখানে দুপুর বেলায় কৌসিক তাকে সব বলতে শুরু করে। সেই ইন্টারভিঊয়ের ভদ্রলোক কেন সত্যজিৎ রায়কে টেনে নিয়ে এলো, তার বক্তব্য এই। এর পর থেকে ‘সুপ্রভাত কাকু’ ‘সুপ্রভাত কৌশিক’ চলতো। আর বিশেষ কথা না। এই ঘটনার পর একদিন সাগর ফোন করে জানালো, আগরতলায় সে একটা ফিল্ম ইন্সটিটিঊট খুলছে। তার আশীর্বাদ চাইলো। আমি জানালাম কৌসিক আসামে কাজ করছে আর তুমি আগরতলায় প্রতিষ্ঠান খুলছো। সেদিন সে বলল, কৌসিক তার কাছে আছে। যদিও সব জানা ছিলো আমার। সেদিন সে আরো বললো, আমাকে তার প্রতিষ্ঠানে সে প্লেনে করে নিয়ে যাবে। ফেসবুকে দেখলাম অনেক কিছু। ভালোও লাগলো। তাদের নতুন ফিল্মের কাজ শুরু হবে। নাম ‘নেপু’।
এর কিছুদিন পর আবার ফিল্মের কাজে পলাশী যেতে হলো। সেখানে তখন আমাদের জরুরী আলোচনা চলছে। কৌশিক ফোন করেছে। কাজের মাঝে বেরিয়ে শুনলাম ওর কথা। জানালে তার নেপু ছবিতে কাজ করার জন্য। কথাটা শুনে আনন্দ হলো। কথাটা পলাশী পাড়ার পরিচালক ও অন্যান্যদের বলতে, সকলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিলো। কাজ সেরে বাড়িতে আসতেই মাকে বললাম, সেও সকলের মতো একই মতবাদ দিলো। আমি নিজে পরলাম দোটানে। সারা দিন খুব চিন্তা করলাম। আমার আরো দুই স্নেহভাজনদের জিজ্ঞাসা করতে সকলে বললে না। কিন্তু আমি কিভাবে না বলবো ভেবে পারছিলাম না।
পরের দিন ফোন করতে প্রথমে বললাম, অনেক দূর। যাওয়া আসা একটা সমস্যা। তবে যদি গল্পটা বলে, আমার শুনে ভালো লাগে, তাহলে চিন্তা করে দেখবো। সে বলল, সে শুধু আমার অংশটুকু বলবে। আমি দাবি করলাম পুরো কাহিনীটা ছোট আকারে। সে একটু থেমে জিজ্ঞেস করে বলল। শুনে দেখলাম, সেই রকম কতো বই বাংলা হিন্দি উড়িয়া অসমীয়াতে হয়ে গিয়েছে। আমি ভেবে বললাম, বাঃ। সুন্দর গল্প। তখন সে জানালো আমাকে সে নিয়ে যাবে ট্রেনে। আমি দাবী করলাম বিমানে নিয়ে যেতে হবে। কারণ সেই অঞ্চলে আমি আগে অফিসের কাজে গিয়েছি, বিমানে। এমনকী, সকালে গিয়ে বিকেলেও ফেরত এসেছি। সে বলল, ট্রেনে অনেকেই আসবে। বলা বাহুল্য, আমি গল্পের আসল চরিত্রের মধ্যে একজন। তাও বললাম, ঠিক আছে। ওখানে থাকা খাওয়া সব ব্যবস্থাই থাকবে। শুটিং’র দু’দিন আগে আসতে হবে। আমি শেষ করলাম এই কথা বলে, আমার পারিশ্রমিক কতো হবে? সে জিজ্ঞেস করলো, তোমার চাহিদা কতো? আমি বললাম, পাঁচ হাজার টাকা প্রতি দিন। মোট ছয় দিনের কাজ। সে জানাবে বলেছিলো। কিন্তু আজও জানায় নি। এর কিছুদিন পর থেকে আমার সাথে হোয়াটস অ্যাপে ‘সুপ্রভাত কাকু’ বলাও বন্ধ করে দেয়। পরে পলাশী পাড়ার পরিচালককে বলেছিলো। সেও অনেক কথা বলেছিলো। কিন্তু কৌসিক আর যোগাযোগ রাখে নি। জানি না আগামী সময় আর সম্পর্ক রাখবে কী না। তবে দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। পলাশীতে আমাদের শুটিঙয়ের কাজ এখনো বাঁকি আছে।