বেড়া উৎসবের ইতিহাস ।। মুহাম্মদ রাইস উদ্দিন


আজ ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। নবাব গঞ্জ আগলা কালোহাটি গ্রামের বেড়া উৎসব দেখতে এলাম।বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসব চলছে। তাই ভাবলাম এই উৎসবের ইতিহাসটা সবার কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।

আসুন এই উৎসবের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নেই-

বাংলাসহ মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যবাহী বেড়া ভাসান ৩১৫ বছর অতিক্রম করেছে- সুবে বাংলার বেড়া উৎসব। নবাবী মুর্শিদাবাদের একটি অতীব ঐতিহ্যবাহী আলোক উৎসব ভাদ্র মাসের বেড়া ভাসান । চলতি বর্ষে এই অভিনব পরব পদার্পণ করছে ৩১৫ বছরে ।  আদতে এই ‘বেড়া’ শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত বেড়া বা প্রাচীর সমার্থক নয় । এই ‘বেড়া’ মূলত ফারসি শব্দ, যার অর্থ দলবদ্ধ জলযান নিয়ে কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে অভিযান করা । ‘বেড়া’র মূল শব্দ ‘ভেলা’ । আঞ্চলিক উচ্চারণে এটি ‘বেড়া’ বলে প্রতীয়মান । ‘বেড়া’ আদপে কলা গাছ নির্মিত ভেলা’কে বোঝায় যে ভেলার কথা পড়েছি আমরা পুরাণ প্রসিদ্ধ বেহুলা লখিন্দরের রূপকথার গল্পে । ‘ভেলা’ মুর্শিদাবাদের বাগড়ি অঞ্চলে ‘ভুঁড়’ বলে পরিচিত, আবার ‘বেড়া’ শব্দের অন্য এক অর্থ নৌবহর ।

বেড়া ভাসান একটি সর্বজনগ্রাহ্য লোক উৎসব । নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওড় অধ্যুষিত এলাকার জনগণ জলের যে কোনো প্রকার অকল্যাণকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য জলের পীর বা দেবতা খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশ্যে বেড়া বা কলার ভেলা ভাসিয়ে থাকে।

সামাজিক ও পারিবারিকভাবে যেমন, তেমনি ফকির সম্প্রদায়ের উদ্যোগেও পালিত হয় এই সার্বজনীন উৎসবটি ।

খোয়াজ এক আরবীয় জলদেবতা বা ফেরেস্তার নাম । প্রাক-ইসলামি যুগে সর্বপ্রাণবাদী চিন্তাধারা থেকে এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে । ১৩শ শতকে, তুর্কি শাসকদের মাধ্যমে খোয়াজ খিজির বঙ্গদেশে প্রবেশ করে এখানকার জনমানসে ক্রমশ স্থায়ী আসন লাভ করেন । মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাব-নায়েব-নাজিমরাও ছিলেন তাঁর ভক্ত । মুকাররম্ খান,  মুর্শিদকুলি খাঁ,  সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিম মহাসমারোহে ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার ঢাকার  বুড়িগঙ্গা এবং মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীতে ভাসিয়েছেন সুসজ্জিত বেড়া ।

বেড়া উৎসব যথার্থই এক সম্প্রীতির মিলনমেলা । উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত মেলাকে সাধারণ মানুষ ভালোবাসেন একান্তই নিজের করে । নানান জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে চারাগাছ বিক্রি এই মেলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য । জেলার বাইরে এবং দূর-দূরান্তের বহু গ্রাম থেকেও মানুষ আসেন হাজারে হাজারে । 

সম্প্রীতির উৎসব হিসেবে নবাব পরিবারও বেড়া’কে তুলে ধরতেন বরাবর । অতীতের জাঁক জমকের আকর্ষণে উপস্থিত হতেন বিভিন্ন প্রদেশের রাজা, জমিদার এবং সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষ আজকের মতোই । বেড়ার জৌলুস ও আলোকসজ্জা দেখে শুধু রাজা জমিদারেরাই নয়, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন তৎকালীন সময়ের ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন স্তরের আমলারাও । বেড়ার সেই গৌরব ধরে রাখতে আশির দশকে রাজ্য সরকারের বিচার বিভাগ ও মুর্শিদাবাদ এস্টেট এর যৌথ উদ্যোগে সন্বৎসর পালিত হয়ে আসছে বেড়া উৎসব । ভাবনার অভিনবত্বে সম্প্রীতির এই বেড়া’কে জেলাবাসী মনে করেন প্রাক-মহালয়া আরও এক দেব বোধন । মোঘল দিল্লীর অধীশ্বরদের নজরানা পাঠাবার অতীতের সেই নবাবী রেওয়াজ আজ মানুষের কাছে এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। রাতভোর শতাব্দী প্রাচীন বেড়া উৎসব দেখার জন্য দেশ ছাড়িয়ে ভিনদেশী পর্যটকেরা এসেও ভিড় জমান, জেলা মুর্শিদাবাদের এহেন সম্প্রীতির আবহ এক অনন্য নজিরবিহীন ঘটনা, আক্ষরিক অর্থেই। 

আজকে আমি যেখানে এসেছি সেখানেও দুর দুরন্ত থেকে ভক্তরা নজরানা নিয়ে এসেছেন গুরু বাড়ি। হিন্দুদের মা গঙ্গা এবং মুসলিমরা খোয়াজ খিজির নামক পীরকে খুশি করতে এই আয়োজন। 

(তথ্য সংগ্রহ নেট থেকে) 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।