আবিদ হাসান কলিংবেল টিপতেই ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল।মা এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো।কিন্তু একি দেখল পাশে একটা মেয়ে বউ বেশে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মা ফারজানা খানমের চোখ উপরে উঠে গেল।তিনি অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।আবিদ হাসান ভয়ে আতঙ্কিত,কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।পরক্ষণে মা জানতে চাইল,
মেয়েটি কেরে?
আবিদ হাসান চুপচাপ কিছু বলছেনা।মা আবার জানতে চাইল,
কিরে চুপ করে আছিস কেনো,মেয়েটি কে?
মা ওহ আমার স্ত্রী ময়না।
কী বললি?
জ্বি হ্যাঁ মা, ওহ আমার স্ত্রী ময়না।
তোর মাথা ঠিক আছেতো?
জ্বি হ্যাঁ মা আছে।
আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।কি হয়েছে খুলে বলতো?
মা ওর নাম ময়না।সে আমার গাড়ির নিচে মাথা ঠুকে আত্নহত্যা করতে চেয়েছিল।আমি কোনমতে গাড়ি ব্রেক করি।সে আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাই।বাঁচানোর পর সে কেঁদে কেঁদে বলে,
সাহেব আমারে বাঁচাইলেন কেন,আমি এখন কোথায় যাব।কার কাছে যাব।
কেনো তোমার মা-বাবা নেই।তাছাড়া তুমি আত্নহত্যা করতে এসেছ কেনো?
সাহেব সে অনেক লম্বা কাহিনী।
আমি শুনব বল।
সাহেব আমি এতিম অসহায় গরীব একটা মেয়ে।ছোট বেলায় মা মারা যায়।বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।সৎ মায়ের অত্যাচারে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।তবুও মুখ বুঝে সব কিছু সহ্য করি।আগামীকাল আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু...।
কিন্তু কি থামলে কেনো বল।
আমার বাবা বর পক্ষকে নগদ এক লক্ষ টাকা বিয়ের আগের দিন দেয়ার কথা ছিল। এন জি ও থেকে ঋন নিয়ে আসার পথে চিনতাইকারী পথে বাবাকে আক্রমণ করে,সব টাকা নিয়ে যাই।খবরটা জানাজানির হওয়ার পর আমার বিয়ে ভেঙ্গে যায়।শোকে, দু:খে, ক্ষোভে, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন।সৎ মা আমাকে অপয়া,অলক্ষণে, বলে অনেক মারধর করে।শুধু তাই নয়,বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মায়ের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।এত রাতে কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না।শেষে কোন উপায় না দেখে আত্নহত্যার পথ বেঁচে নিলাম।এখন আমি কোথায় যাব।আমার যে যাওয়ার যায়গা নেই।
সে কাঁদে আর কাঁদে।তার কান্না যেন শেষ হচ্ছে না।এত রাতে অসহায় একটা মেয়েকে কোথায় ফেলে আসি ভেবে পাচ্ছিলাম না।তাই কোন উপায় না দেখে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসলাম।
ওহ খুব ভালো মেয়ে।ওকে মেনে নাও মা।
আবিদ হাসান খান বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী।ফারজানা খানম এমন একটা হাভাতে মেয়েকে কি বউ হিসেবে মেনে নেবেন?কখনই না।তিনি কড়া ভাষায় বললেন,
আবিদ তুমি ছেলে মানুষ ভালো মন্দ বুঝনি।তাই বিপদে পড়ে একটা ভুল করেছ।আমি মা হয়েতো তা মেনে নিতে পারিনা।ওহ রাস্তার মেয়েে রাস্তায় থাকবে।মহলে আসবে কেনো।তাছাড়া যাকে যেখানে মানায় তাকে সেখানে থাকতে হয়। ওহ আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে হওয়ার ও যোগ্যতা নেই,বউ হওয়াতো দূরের কথা।ওর টাকার দরকার এইতো।কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও।
আবিদ হাসানের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।সে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মা চোখ রাঙিয়ে বলে,
আবিদ দাঁড়িয়ে আছিস কেনো,ওকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আস।
প্লিজ মা,শান্ত হও,বুঝতে চেষ্টা কর।এত রাতে ময়না যাবে কোথায়?
সেটা তোমার বুঝার বিষয় নয়।যা বলেছি তাই কর।লোক জানাজানি হওয়ার আগে ময়নাকে ফেলে দিয়ে আস।
মা আমি এমন অন্যায় কাজ করতে পারব না।আল্লাহপাক এমন অন্যায় বরদাস্ত করবেননা।তাছাড়া ময়না আমার স্ত্রী।আল্লাহপাকের বিধান অনুযায়ী ওকে আমি বিয়ে করেছি।এখন অস্বীকার করব কিভাবে।
তার মানে তুমি ওকে ফেলে আসবেনা।
জ্বি না মা।
তাহলে আমি তাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি।
তিনি আর দেরী করলেন না।ময়নার গাড় ধরে ধাক্কা মারতে মারতে বললেন,
এই ফকিন্নির বাচ্চা ফকিন্নি তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ,উঠ বলছি,আমি তোকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসব।
চোখের জলের আর বাঁধ মানল না।অজর ধারায় জরতে লাগল।ময়না কেঁদে কেঁদে ফারজানা খানমের পা দুখানা চেপে ধরে বলে,
মা আমায় তাড়িয়ে দিয়েন না।আমায় একটু থাকার জায়গা দিন।আমি কখনো স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আপনার ছেলের সামনে দাঁড়াব না।কাজের মেয়ে হয়ে থাকব,সব কাজ করে দেব।
সত্যি বলছিস?
জ্বি হ্যাঁ মা সত্যি।
যাক ফারজানা খানম শান্ত হলেন।ময়নার থাকার জায়গা হল।সকাল হলে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আযান ধ্বনি বেজে উঠল।ময়না ফজরের নামাজ পড়ে সবার জন্য নাস্তা রেডি করল।ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে সবাইকে ডাকল।আবিদ হাসান নাস্তা করে অফিসে চলে গেল।মা ফারজানা খানম এখনো নাস্তার টেবিলে এমন সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠল।ইউ এস এ থেকে বান্ধবী রিজিয়া চৌধুরী ফোন করেছে। তিনি আনন্দের সহিত ফোন রিসিভ করে বললেন,
হ্যালো আপু কেমন আছেন?
ভালো।আপনি কেমন আছেন?
ভালো।তো আবিদ রিশার বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?
এতে ভাবাভাবির কি আছে।বিয়েতো ঠিক হয়ে আছে।আপনি যখন বলবেন তখন।
তবুও, আবিদের মতামত নেয়ার দরকার আছে,মতামত নিয়েছেন?
আবিদ আমার হীরের টুকরো ছেলে।আমার কথার উপর কোন কথা বলবেনা।
সেটা আপনি ভালো বুঝেন।
তো আর বলছি কি।
তারা আর ও কিছু সময় ফোনে খোশ-গল্প করল।তারপর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করল।পনেরো দিন পর বিয়ে।ময়না পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনল।ক্ষোভে,দু:খে বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তবুও কাউকে কিছু বলতে পারছেনা।এমনকি আবিদ হাসানকেও না।ভয়ে আবিদ হাসানের মুখের দিকেও তাকাতে পারছেনা।কাছে ঘেষা তো দূরের কথা।আবিদ হাসান ও মায়ের ভয়ে চুপ,ময়নার ধারে কাছেও যায়না।
ফারজানা খানম ছেলেকে না জানিয়ে ভাইকে নিয়ে বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন।বউয়ের জন্য অলংকার বানানোর অর্ডার দিলেন।দাওয়াতি কার্যক্রম ও শুরু হলো।
আবিদ হাসান এসবের কিছুই জানেনা।নাস্তার টেবিলে বসতে মা বলল,
আবিদ আজ বিকেলে তোমাকে আমার সঙ্গে বিমান বন্দরে যেতে হবে।
কেনো মা?
আমার বান্ধবী রিজিয়া তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসছে।তাকে রিসিভ করতে যেতে হবে।
মা আমি যেতে পারব না।অফিসে কাজ আছে।তুমি বরং মামাকে নিয়ে যাও।
বাবা আবিদ তুই না গেলে যে রিশা রাগ করবে।তাছাড়া এতদূর থেকে এসে মেয়েটা যদি প্রিয় মানুষটিকে না দেখে কেমন হবে বলতো?
মা আমি ঠিক বুঝলাম না।
বুঝিয়ে বলছি শুন,আমার বান্ধবী রিজিয়া চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে রিশা আমেরিকা থাকে।অনার্স মাস্টার্স,চেহারা ও ভালো সুন্দরী,টাকা পয়সার কমতি নেই। ঢাকাতে দূটো বাড়ি।আমি ভেবে দেখলাম এই মেয়েই আমার
একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার যোগ্য।তাই বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম।পনেরো দিন পর বিয়ে।এদিকে বিয়ের আয়োজন প্রায় কমপ্লিট।
মা এসব করার আগে আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করলেনা।মা আমি এ বিয়ে করব না।
কেনোরে সমস্যা কোথায়?
মা সমস্যা অনেক, বিদেশে থেকে লেখা-পড়া করা মেয়েরা মডার্ন আনকালচার্ড,এমন মেয়ে আমি বিয়ে করবনা।
বোকার মতো কথা বলো না।এই ডিজিটাল যুগে মডার্ন মেয়ে না হলে চলেনা।এই বিয়ে তোমাকে করতে হবেই।এটা আমার অর্ডার।
মা ময়না খুব ভালো মেয়ে,পর্দানশীন নামাজী, গুণবতী, দেখছনা সংসারের কাজ কেমন গুছিয়ে করছে।প্লিজ মা তাকে বউ হিসেবে মেনে নাও।সে তোমার সব কাজ করে দেবে।
ময়নার কথা শুনে ফারজানা খানমের রাগ চরমে উঠে গেল।তিনি চোখ জোড়া রক্তবর্ণ করে বললেন,
আবিদ ময়নার ব্যাপারে আর একটা কথা ও বলোনা।রাস্তার দুটাকার মেয়ে কখনো খান বংশের বউ হতে পারেনা।এটা তুমি ভালো করে জান।এই নিয়ে ফের কোন তর্ক করোনা।
মা বিয়ে মানুষের জীবনে একবার হয়,বারবার না।ময়না আমার বিবাহিতা স্ত্রী,তাকে বাদ দিয়ে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবনা।
আবিদ এটাই কি তোমার শেষ কথা?
জ্বি হ্যাঁ মা।
তাহলে তুমি ও শুনে রাখ, ময়নাকে আমি চিরদিনের মতো দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলব।আর কখনো দেখবেনা।দেখি তুমি তাকে রক্ষা কর কিভাবে।
ফারজানা খানম অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি।ভিলেন ভাড়া করা কোন ব্যাপার না।যে কোন মূহূর্তে ময়নাকে মেরে ফেলতে পারেন।আবিদ হাসান তা বুঝতে পেরে বলল,
প্লিজ মা,শান্ত হও,ময়নাকে মেরোনা।আমি তোমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব।
সত্যি বলছিস,নাকি অভিনয়?
জ্বি হ্যাঁ মা সত্যি।
আমার মাথা ছুঁয়ে শফথ কর,আর কখনো ওর নাম মুখে আনবিনা।ওকে বউ হিসেবে শিকার করবিনা।
ঠিক আছে মা করবনা।
ছেলের মুখে শফথ শুনার।পর মায়ের মন শান্ত হল।
ময়না আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনল।আস্তে করে আবিদ হাসানের পিছু নিলো।মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার ঘরে গেল।আস্তে করে বলল,
আমার একটা কথা রাখবেন।
পিছন ফিরে ময়নাকে দেখে আবিদ হাসানতো অবাক।মা দেখলে রক্ষা নেই।তাই আস্তে করে বলল,
ময়না তুমি!বল কি কথা?
আমার কথা ভেবে মন খারাপ করবেন না।আপনাদের বাসায় থাকতে দিয়েছেন,এতে আমি সুখী।আর বেশি কিছু চাইনা।আপনি মায়ের কথা মতো বিদেশি ম্যামকে বিয়ে করুন।
ময়না আমি বুঝি তোমার কষ্ট।কিন্তু কি করব,আমি যে পরিস্থিতির স্বীকার।অন্যায় জেনেও কোন প্রতিবাদ করতে পারছিনা।সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে। আমি অপরাধী,আমায় ক্ষমা করে দিও ।
আপনার উপর আমার কোন রাগ নেই।আপনি আমার জন্য যা করেছেন তাতে আমি ধন্য।
আঁচলে মুখ বুঝে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল ময়না।আবিদ হাসান একবুক দু:খ নিয়ে অফিসে চলে গেল।
সময়মতো ফারজানা খানম আবিদ হাসানকে নিয়ে বিমান বন্দরে উপস্থিত হলো।রিজিয়া চৌধুরী মেয়েকে নিয়ে বের হল।দুবান্ধবী কুশল বিনিময় করে কোলাকুলি করল।আবিদ হাসানকে পরিচয় করিয়ে দিলো।সে ভদ্রতার সহিত সালাম দিলো।রিশাকে পরিচয় করাতে সে সালাম না দিয়ে বলল,
Hi Aunt how are you?
I am fine.
তারপর আবিদ হাসানকে পরিচয় করাতে তার হাত চেপে ধরে বলল,
Hi sweet heart,এত লজ্জা করছ কেনো?চলো আমরা ঐদিক থেকে একটু ঘুরে আসি।
আজ না,অন্যদিন ঘুরা যাবে।এখন বাসায় চলো।
কোনমতে বুঝিয়ে রিশাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসল।
এদিকে ময়না বাসার সমস্ত কাজ গুছিয়ে নাস্তা রেডি করে রাখল।মেহমান আসার সাথে সাথে সবার সামনে সুন্দর ভাবে তা পরিবেশন করল।ময়নাকে দেখে রিজিয়া চৌধুরীর চোখ উপরে উঠে গেল।মনে মনে বলে,এমন একটা সুন্দরী মেয়ে কাজ করছে ব্যাপার কি,জানতে চাইল,
আপু মেয়েটি কেরে?
আমাদের কাজের মেয়ে।
রিজিয়া চৌধুরী তো অবাক,
কাজের মেয়ে এত সুন্দরী হয়,আগে দেখেনিতো কখনো।
খাওয়া শেষ সবাই টিভি দেখতে সোফায় বসে পড়ল।
ময়না তার ঘরে গিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে এশার নামাজ পড়তে বসল।নামাজ শেষে আল্লাহপাকের দরবারে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করে,
হে পরম করুনাময় আল্লাহ আমি পাপী বান্দার প্রার্থনা কবুল করে নাও।আমি জনম দু:খিনি, জন্মের পর থেকে দু:খ কষ্টে আছি।তবুও তোমার দরবারে শুকরিয়া।আজ আমার স্বামী অন্যের দখলে চলে গেছে।তাকে কখনো কাছে পাবনা।এই না পাওয়ার বিরহ ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা দাও, ধৈর্য দাও, প্রভু।আমার স্বামীকে ভালো রেখো,সুস্থ রেখো প্রভু।আমিন।
নামাজ শেষ ময়না উঠে দাঁড়াল।এমন সময় ফারজানা খানম তার সামনে দাঁড়াল।
ভয়ে ময়নার বুক ধড়ফড় করে উঠল।আস্তে করে বলল,
মা আমায় কিছু বলবেন?
হ্যাঁ বলব।
জ্বি মা বলুন।
এ বাসায় তোর পরিচয় কাজের মেয়ে।এর বাইরে উল্টা পাল্টা যদি কিছু বলিস জ্যান্ত কবর দেব।কথাটা মনে রাখিস।
কড়া ধমক দিয়ে ফারজানা খানম চলে গেল।
সময়মতো বিয়ের কাজ শুরু হলো।
খুব জাঁকজমক ভাবে আবিদ হাসানের বিয়ের কাজ শেষ হলো।রিশা খান বংশের একমাত্র পুত্রবধু হয়ে আসন পেতে বসল।খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমাচ্ছে আমোদ ফুর্তি করছে।আবিদ হাসান কিন্তু ততোটা খুশি নয়।ময়নাকে বুকের মধ্যে লালন করছে।তার চিন্তায় সে অস্থির। মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছে।রিশাকে মনের মতো করে ভালোবাসতে পারছেনা।এই সুযোগে রিশা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরাফিরা করছে।দৃশ্যটি আবিদ হাসানের চোখে পড়তেই সে বলল,
রিশা তুমি এ বাড়ির বউ।আমার বিবাহিতা স্ত্রী।আমার অর্ডার ছাড়া কখনো বাড়ির বাইরে বের হবেনা।লজ্জা করল না,একজনের বউ হয়ে পর পুরুষ নিয়ে ঘুরতে?
না করলোনা।কারণ এটা আধুনিকতা।
আধুনিকতা না ছাই।এটা হচ্ছে , বেহায়াপনা, নোংরামি,অশ্লীলতা, আমি এসব পছন্দ করিনা।সাবধান আর কখনো এমন বেহায়াপনা করবেনা।
রিশা এসব মানলেতো।দুজনের তর্ক চরমে উঠে যায়।ফারজানা খানম কোন রকমে তা ধাপাচাপা দেয়।রিশার পক্ষ হয়ে আবিদ হাসানকে দুচারটা কড়া কথা বলে।পরিবেশ আপাতত শান্ত হল।
এর ফাঁকে কেটে গেল কিছুদিন।চা করতে দেরী হওয়াতে ময়নার চুলের মুষ্টি ধরে ঠাস ঠাস চড় বসিয়ে দিলো রিশা।আবিদ হাসান সহ্য করতে না ফেরে রিশার হাত চেপে ধরে বলল,
ওকে মারছ কেনো?কি দোষ করেছে।
চা করতে এত দেরী হলো কেনো?
তাই বলে এত মার মারবে?
হ্যাঁ মারব তাতে তোমার কি?
আমার কি মানে,সাবধান আর কখনো ময়নার গায়ে হাত তুলবেনা।
তুললে কি করবে?
সময়মতো দেখবে কি করি।
কাজের মেয়ের জন্য এত দরদ, তার সঙ্গে কি তোমার গোপন কোন সম্পর্ক আছে।
আবিদ হাসান মনে মনে বলে,তার সঙ্গে কি সম্পর্ক শুনলে তুমি স্থির থাকতে পারবেনা।
তাদের তর্ক চরমে উঠে যায়।ঝগড়ার রুপ ধারন করে।ফারজানা খানম এগিয়ে এসে বলে,
কি হয়েছে তোরা এত চেঁচাচ্ছিস কেনো?
এই সেরেছে রিশা মায়া কান্না কেঁদে বলে,
মা আপনার ছেলে সামান্য একটা কাজের মেয়ের জন্য আমাকে যা খুশি তা বলল।আমি আর এ বাড়িতে থাকব না উঁঃ উঁঃ উঁঃ..।
মা কাঁদিস না।তোর বাড়ি ছেড়ে তুই কোথায় যাবি।বরং এই ফকিন্নিকে বাড়ি থেকে তাড়াব।
আবিদ তুমি ভালো করলেনা।রিশাকে কাঁদানো তোমার উচিৎ হয়নি।তুমি ভালো করে জান এর পরিণাম কি হবে।নিজেকে শুধরে নাও।বউকে ভালোবাসতে শিখ।কাজের মেয়ে নিয়ে নাক গলাবেনা।এতে সংসারের আশান্তি বাড়বে, বৈ কমবেনা।কথাগুলো মাথায় রেখো।
মায়ের কথার উপর কথা বললে হিতে বিপরীত হবে ময়নাকে নির্যাতন করবে।তাই কোন প্রতিবাদ না করে সে অফিসে চলে গেল।
কথায় বলেনা ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সত্য কোনদিন গোপন থাকেনা।আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে যায়।ঠিক এক সময় প্রকাশ হয়ে গেল,আবিদ ময়নার বিয়ের গোপন খবর।সেই থেকে ময়না রিশার চক্ষের শূল।পান থেকে চুন খসলে মারধর করে নির্যাতন করে।
ময়না কোন প্রতিবাদ করেনা।নীরবে সবকিছু হজম করে সংসারের কাজকর্ম করে চলেছে।রিশা পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে,আর বন্ধু বান্ধবী নিয়ে বিভিন্ন পার্টিতে ঘুরে বেডাচ্ছে।অনেকে বাসা পর্যন্ত আসছে।ফারজানা খানম এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেননা।আজ একজন বাসায় এসেছে,তার জন্য চা নাস্তার অর্ডার করল।একটু দেরী হলো।অমনি রিশা খুনতি গরম করে ময়নার সমস্ত গা ফুড়ে দিলো।ময়না উঁঃ আঃ শব্দ করে ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর বলছে,
কে কোথায় আছ দেখে যাও ম্যাম সাহেব খুনতি দিয়ে আমার গা ফুডে দিয়েছে। আমি সইতে পারছিনা।যন্ত্রণায় গা ফুডে যাচ্ছে।
আবিদ হাসান যাতে জানতে না পারে। রিশা চোখ রাঙিয়ে বলল,
চুপ একদম চুপ।আবিদের কানে কথাটা দিয়েছতো মরেছ। সাবধান তাকে জানানোর চেষ্টা করবেনা।
ফারজানা খানম দেখেও না দেখার ভান করে আছেন।
কারণ তার পরামর্শে এসব করা হচ্ছে।তিনি চান ময়না মরে যাক।যদি কখনো স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আবিদ হাসানের সামনে দাঁড়ায়।তাই ময়নাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছেন।
ময়না শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে।রান্না করা হয়নি।ডাইনিং টেবিল শুন্য।খেতে বসে সবাই চেঁচামেচি।আবিদ হাসান জানতে চাইল,
ময়নার কি হয়েছে?
রিশা বলল,
তেমন কিছুনা। সামান্য জ্বর,অমনি রান্না করা ছেড়ে দিয়েছে।যত্তসব ঢং,
আবিদ হাসানের সন্দেহ হল।ময়নাকে দেখার জন্য সামনে পা এগিয়ে দিলো।তখনি রিশা সামনে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে বলল,
এই তুমি কোথায় যাচ্ছ?
ময়নাকে দেখতে।
সামান্য জ্বর,এতে দেখার কি হল?
তাই বলে ময়না মরে যাবে।
মরবেনা,আমি জ্বরের ঔষধ দিয়ে এসেছি।
তবুও আমি একটু দেখে আসি।
না তুমি দেখবেনা।ওর জন্য তোমার এত দরদ কিসের।তুমি কখনো ওর ঘরে যাবেনা।এটা আমার অর্ডার।
পাশ থেকে ফারজানা খানম বলল,
রিশা ঠিক বলেছে,ময়নাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।অফিসের সময় হয়েছে,অফিসে যাও।তাকে আমরা দেখব।
আবিদ হাসানের মন মানল না।অফিসে যাওয়ার পথে ডাক্তার সানোয়ার হোসেনকে পাঠিয়ে দিলো।ডাক্তার বাসায় আসলে ফারজানা খানম বলল,
ডাক্তার সাহেব ময়না সুস্থ আছে।তাকে দেখা লাগবেনা।চলে যান।
কি আর করা ডাক্তার তার গন্তব্যস্থলে ফিরে গেল।আসার পথে আবিদ হাসান বলল,
ডাক্তার সাহেব রোগীকে কেমন দেখলেন।
রোগী ভালো আছে।
আবিদ হাসানের মনে আশার আলো জ্বলে উঠল।পরদিন সকালে সে অফিসের কাজে সপ্তাহ খানেকের জন্য বাইরে গেল।এসে একি দেখল,ময়নার মুমূর্ষু অবস্থা,কোন সাড়া শব্দ নেই।সমস্ত শরীর ফুড়ে ফোসকা পড়ে, পঁচন ধরেছে।গায়ে প্রচণ্ড জ্বর শ্বাস-কাশ বেড়ে গেছে।আবিদ হাসান আর দেরী করলোনা।তাকে তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালে নিয়ে গেল।জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করলো।স্যালাইন ইনজেকশন পুস করলো।
ঘন্টা খানেক পরে ময়না আবিদ হাসানের দিকে চোখ মেলে তাকাল।কিছু বলতে চাইল।আবিদ হাসান বলল,
ময়না কিছু বলবে,তোমার এ অবস্থা হলো কি করে?
ময়নার চোখ থেকে জল পডছে।বহুকষ্টে উত্তর দিলো,
রিশা ম্যা..ডা...ম...খুন...তি...দি..য়ে. ..ফু...ড়ে দিয়েছে।এ কদিনে...কিচ্ছু...খেতে. ..দেয়নি।এক ফোটা. ..পানিও না।আমায়. ...মাফ...করে. .দিয়েন।
সে আর কথা বলতে পারলোনা।মারা গেল।
আবিদ হাসানের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ডাক্তার বলল,
আবিদ সাহেব অনেক দেরী করে ফেলেছেন।আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।তবুও বাঁচাতে পারলাম না। লাশ নিয়ে যান।দাফনের ব্যবস্থা করণ।
ময়নাকে সময়মতো দাফন করা হলো।আবিদ হাসানের মনে একবিন্দু শান্তি নেই।বারবার ময়নার কথাগুলো মনে পড়ছে।ঠিকমতো অফিস করতে পারছেনা।কেমন জানি মনমরা হয়ে বসে থাকে।
এদিকে বউ শ্বাশুড়ি ময়নার মৃত্যুতে খুশি দিবস পালন করছে।রিশা ফোন করে বলে,
হ্যালো মাম্মি আপদটা বিদায় হয়েছে।ময়না মারা গেছে।
কিভাবে মরল?
শুন বলছি মাম্মি।
সে আর দেরী করলনা।ময়নাকে নির্যাতনের সকল ঘটনা বলল।আবিদ হাসান আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনল।কেলেংকারীর ভয়ে কোন প্রতিবাদ করলনা।রিশার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল।প্রচণ্ড ঘৃণার জন্ম হলো।
একদিন রিশা অভিযোগ তুলল।
মা আপনার ছেলে আগের মতো আমার সাথে কথা বলেনা।মুখ ভার করে থাকে।কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়না।মনে হয় ময়নাকে ভুলতে পারছেনা।আপনি কিছু একটা করুন।
রিশা চিন্তা করোনা।কদিন যাক সবঠিক হয়ে যাবে।মৃত মানুষকে কদিন মনে রাখবে।
আবিদ হাসান ময়নার জন্য মসজিদে মিলাদ পড়ালো।এতিম খানার বাচ্চাদেরকে খাওয়ালো।আসার পথে ডাকাতদল আক্রমন করলো।সব টাকা নিয়ে গেল।তাকে জখম করে রাস্তায় ফেলে গেল।পথচারীরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করালো।খবর শুনে ফারজানা খানম স্ট্রোক করলেন।কারণ তার স্বামীর ও মৃত্যু হয়েছে ডাকাতের হাতে।আজ আবার ছেলেটাকে ও ডাকাতদল আক্রমণ করলো।যদি মরে যায়, কথাটা ভাবতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
উনাকেও দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।মা ছেলের চিকিৎসা চলছে।ছেলে সুস্থ হয়ে মায়ের সেবা যত্নে ব্যস্ত।উনি মোটামুটি সুস্থ হলেন।কথা বলতে পারছেন।তবে এক হাত এক পা অবশ হয়ে যায়।সপ্তাহ খানেক চিকিৎসার পরে বাসায় নিয়ে আসা হয়।উনি হাটতে পারেন না।হুইল চেয়ারে করে হাটাচলা করতে হয়।তার দেখাশুনার দায়িত্ব পড়ে রিশার উপর।সে ছাপ ছাপ বলে দেয়, আমি এসব পারবনা।
অযত্ন আর অবহেলায় জর্জরিত ফারজানা খানমের জীবন। ঠিকমতো ঔষদ পথ্য, খাবার খেতে দেয়া হচ্ছেনা।ঠিক ময়নার মতো।ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।রিশাকে ডাকে,সে শুনে ও না শুনার ভান করে থাকে।মন চাইলে দুচারটা ডালভাত খেতে দেয়।এভাবে আর কতদিন।
এক সময় তিনি সিরিয়াস অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখেন,ময়না তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে তিনি ডুকরিয়ে কেঁদে উঠে বলেন,ময়না তুই এসেছিস।বস, আমার পাশে বস।
মা আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন।
ঠিক বলেছিস।রিশা আমারে ঠিকমতো খেতে দেয়না।অনেক দিন খাইনা।আমায় একটু খেতে দিবি।
ময়না এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো,বস।তুই কি এখনো আমার উপর রেগে আছিস,থাকবিতো।
আমি যে, তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি,জুলুম করেছি।ন্যায় অন্যায় বুঝেনি।কি করব বল,মা-বাবা কখনো ইসলামিক জ্ঞান শিক্ষা দেয়নি।কোরান হাদিস শিখায়নি।নামাজ রোজা করায়নি।শুধু দুনিয়ার বিদ্যা আর ঐশ্বর্য শিখিয়েছে।তাই টাকার গরমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।আল্লাহকে ভুলে গেছি।নামাজ রোজা করিনি।পরকালের কথা ভাবিনি।বিদেশিদের কৃষ্টিকালচার্ড ফলো করেছি।স্টার ঝলসা আর সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত..।তাই মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হয়েছি।এই জন্য তোর মতো একটা নিষ্পাপ ভালো মেয়েকে মারার পরামর্শ দিয়েছি।এখন সব বুঝতে পেরেছি।আমি কঠিন পাপি।আমার এ পাপ আল্লাহ ও ক্ষমা করবেন না।ময়না আমি হাতজোড় করে বলছি,তুই আমাকে মাফ করেদে।নইলে যে পরকালে কঠিন সাজা ভোগ করতে হবে।
মা মাফ চেয়ে আমাকে গুনাগার বানাবেননা।আপনার উপর আমার আর কোন রাগ নেই।তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান।আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন।আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
ময়না তুই ঠিক বলেছিস।
আমি আর এ পাপের জগতে থাকবনা।তুই আমারে নিয়ে যা।আমি তোর কাছে থাকব।
জ্বি না মা আমি আপনাকে নিতে পারবনা।আমি গেলাম।
ময়না যাসনে।আমায় নিয়ে যা।
ময়না আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।ফারজানা খানম ময়না ময়না বলে চিৎকার করছে।তার চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠেছে।আবিদ হাসান ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,
মা কি হয়েছে।চিৎকার করছ কেনো?
ময়না এসেছে।
কোথায়?
ঐতো চলে যাচ্ছে।তাকে ফেরা,আমি তার সঙ্গে যাব।এই নরকপূরীতে আর থাকব না থাকব না,থাকব না।
বলতে না বলতে শ্বাস-কাশ বেড়ে যায়।তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।আবিদ হাসান কান্নায় ভেঙে পড়ে।