মুন্সিবাড়ী। রহমতপুর গ্রামের মুন্সিবাড়ী। রহমতপুরের চেয়ে মুন্সিবাড়ীকেই মানুষ বেশি চেনে। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে আছে নাম-মুন্সিবাড়ী। এই মুন্সিবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা রহমত আলী মুন্সি। লোকে বলত রহমত মুন্সি। খুব সৎ লোক ছিলেন তিনি ।
ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে সারাদেশে যখন রায়ট চলছিল সেই সময়ে আসাম থেকে তিনি এসেছিলেন এই বাংলায়। জীবন বাঁচার তাগিদে খালি হাত-পা নিয়ে আসা আর কি। তবে নিজ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। রহমত মুন্সিকে আমাদের সমাজে আজ সবাই চেনে একজন সহজ-সরল-সৎ মানুষ হিসাবে।
মুন্সি পরিবারে সাত মেয়ে জন্মানোর পরে অনেক চেষ্টা তদবিরে একটা ছেলে জন্মালো। মুন্সি পরিবারের একমাত্র বাতি নাম হামেদ মুন্সি। হামেদ মুন্সি বড় আদরের। সাত বোনের একমাত্র ছোট ভাই সে। পরিবারের সবাই তাকে খুব স্নেহ করে।
চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছোট তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রহমত মুন্সি গ্রামেই থাকেন। তিনি গ্রামের লোকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি মাদরাসা আর একটি মসজিদ। গ্রামের মাদরাসায় পড়ানোর পাশাপাশি তিনি মসজিদে ইমামতি করেন। আর ছেলে মেয়েরাও লেখাপড়া করেন। ভালোই যাচ্ছিল তার দিনকাল।
১৯৭১ সাল। যুদ্ধের বছর। বৈশাখ কি জ্যৈষ্ঠ মাস। কয়েক দিন থেকে খুব গরম পড়ছিল। শহরে পাকিস্তানি সেনারা মানুষ মারছে বেধুম। তাই শহর থেকে মেয়ে জামাই এসেছে। গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। মুন্সি বাড়ি গমগম করছে। রহমত মুন্সি এশার নামাজ পড়ে বাড়িতে এসে বউ-বাচ্চা নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় গ্রামের মাতব্বর সনু দফাদার আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মুন্সি বাড়িতে হাজির।
সনু দফাদার রহমত মুন্সিকে দেখেই বলে উঠল, আসছ ইন্ডিয়া থেকে। আবারো করো ইন্ডিয়ার দালালি । দেশে থাকতে চাস তো ইন্ডিয়ার দালালি ছাড়। মাতব্বর সাব, কি যে বলেন, রহমত মুন্সি জবাব দেয়।
দফাদারের পাশে থাকা তাজুদ্দিন ফকির চেঁচিয়ে ওঠে-কি বলবে হে, গ্রামের মসজিদে ইমামতি করো। মেয়ে জামাই শহর থেকে এসে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তার কি খোঁজ রাখ।
তফের বলল, আপনে ইমামতি করবেন আমাদের গ্রামে আর আপনের জামাই করবে মালাউনের দালালি। আপনের পিছনে নামাজ পড়াই হারাম । আপনে আবার ইমামতি করবেন !
আর একজন গলা বাড়িয়ে বলল, হারাম, হারাম, বিলকুল হারাম। আমরাও ধর্ম জানি-মানি । এই পাক-পবিত্র পাকিস্তানে ইন্ডিয়ার দালালি চলবে না। কে একজন ঘৃণা ভরে বলে উঠল, ছি! ছি! না জেনে এই বেইমান লোকটার
পিছনে নামাজ পড়ে কতই না গুনাহ করেছি। মাফ করো আল্লাহ ।
আর একজন বলল, আরে, এইটাই তো হবে। উনি কি আর পাকিস্তানকে ভালোবাসবেন, উনি তো ইন্ডিয়ায় জন্মাইছেন। রায়টের সময় জীবনের ভয়ে এখানে এসেছিলেন। আর এখন সময় মত ইন্ডিয়ার দালালি করবেন। এটাইতো স্বাভাবিক।
বিভিন্ন জনের কথা শুনে রহমত মুন্সি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।
এবার সনু দফাদার দু' পা এগিয়ে রহমত মুন্সির একদম মুখোমুখি হয়ে হাত উঁচিয়ে বলল, জেনে রাখ, আল্লাহ শুধু দুইটা দেশ গড়ছে, একটা সৌদি আরব আর একটা পাকিস্তান। আর পাকিস্তান মানে পবিত্র স্থান। পৃথিবী ধ্বংস হলেও পাকিস্তান টিকে থাকবে। এখনো সময় আছে গ্রামে থাকতে হলে সংশোধন হও, নইলে প্রাণ নিয়ে ইন্ডিয়া যাও।
রহমত মুন্সির মুখে একটি কথাও সড়লো না। পা দু' টো ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল ।
সনু দফাদার দেরী না করে চলে গেলেন। সঙ্গীরাও পিছনে পিছনে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে চলে গেলেন।
রহমত মুন্সি বেশ খানিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ছেলে-মেয়েরা পুকুর ঘাটের বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রহমত মুন্সিকে ঘরে নিয়ে গেল । এরি মাঝে বেশ কয়েক দিন দফাদারের লোক এসেছিল জামাই আর ছেলেকে খুঁজতে। না পেয়ে মুন্সিকে শাসিয়ে গেছে। দফাদারের ডান হাত বলে পরিচিত তাজুদ্দিন ফকির শাসিয়ে গেছে- আসছে শুক্রবার মসজিদে দেখা হবে।
গেল রাতে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল মুন্সি বাড়িতে। বেশ রাত ধরে সবাই মিলে অনেক পরামর্শ করল। শেষ রাতে শুধু ডাল ভাত খেয়ে গ্রামের আরো বেশ কয়েকজন যুবক ছেলেকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার দল চলে গেল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ওপারে গেছে।
সেদিন শুক্রবার। জুম্মার দিন। শোনা যাচ্ছে পাক সেনারা আজ গ্রামে ঢুকতে পারে। রহমত মুন্সির মাদরাসায় তারা ক্যাম্প গড়বে। তাই সকাল থেকে গ্রামে কেমন একটা আতঙ্ক ভাব। রহমত মুন্সি যাই যাই করে বেশ দেরীতে মসজিদে গেল। মসজিদে এরি মাঝে বেশ কয়েকজন এসেছেন। রহমত মুখে চুপ করে মসজিদের ভিতরে বসে পড়লেন।
নামাজের সময় তাজুদ্দিন ফকির সনু দফাদারের নাম উল্লেখ করলেন। দফাদার উঠে নামাজ পড়ালেন। তারপর দোয়া করে যে যার মত ঘরে ফিরলেন। সনু দফাদার তার লোকজনকে নিয়ে মসজিদে বসলেন। রহমত মুন্সি ঘরে। ফিরে গেল।
সত্যিই সেদিন থেকে রহমত মুন্সির দিনকাল বেশ খারাপ যাচ্ছিল। আজকের নামাজ শেষে তিনি ঘরে ফিরেই একটু বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করলেন। এরি মাঝে মাতব্বরের লোক হাজির । রহমত মুন্সি বাধ্য হয়েই মসজিদে গেলেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা অনেকগুলো লোককে দাঁড় করিয়ে কি যেন
বলছে। নেতা গোছের একজন সেনার বাম পাশে সনু দফাদার, তার বামে
জোয়ান ছেলে ফরিদ গাজী আরো অনেকে।
অবস্থা দেখে মুন্সির কলজেটা কেঁপে উঠল। তিনি বড় দোয়া পড়তে লাগলেন। মুন্সি হাজির হলেই নেতা গোছের সেই সেনাটি বললেন, মুক্তি কে হ্যায়।
রহমত মুন্সির পাঁ ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। প্রাণের ভয়ে কথাটা তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাই তিনি এর কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি শুধু হাত তুলে সনু দফাদারসহ সবাইকে দেখিয়ে মাথা নিচু করে বললেন, আমরা সবাই বাংলাদেশে থাকতে চাই। আমাদের মাঝে কোনো বিরোধ নাই স্যার।
সেনা কর্মকর্তা যে কি বুঝলেন। হয়তবা তিনি ভাবলেন মুন্সি সাহেব বলেছেন, সনু দফাদার আর তার ছেলেসহ সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। তাই রাগে তার চোখে রক্ত উঠল। শালা, হারাম খোর, মালাউন বলেই বাম পাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে সনু দফাদারের যুবক ছেলের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। অমনি রক্তের সাথে ফিনকি দিয়ে মগজ বেরিয়ে গেল। সনু দফাদার আর্তনাদ করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল । অমনি আবারো গুলির শব্দে নিভিয়ে গেল সনু দফাদারের জীবনটা।
আচমকা এই ঘটনায় যে যেদিকে পারল ছুটে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। যারা তখনো মসজিদ পর্যন্ত পৌছায়নি তারা পথ ঘুরিয়ে প্রাণ নিয়ে ছুটল ।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের অনেকের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে সেদিনের মত গ্রাম ছাড়ল।
সরফ উদ্দিন বেশ অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। কারো সাত-পাঁচে নাই। রাজাকারেরা এসেছিল তার কাছে কিছু খরচ চাইতে। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনাটা তিনি ভুলে যাননি। সবার সামনে তিনি বলেই ফেললেন, তোমরাইতো দেখছি। নিমক হারাম, বেইমান। সনু দফাদারের কি দোষ ছিল সেদিন। জোয়ান বেটা সহ লোকটাকে ওরা গুলি করে মারল। পাকিস্তানের জন্য লড়াই করতে গিয়ে শেষে না পাক আর্মির কাছেই তাকে জীবন দিতে হলো।
তোরা কি জানিস-পাকিস্তানিরা যদি আমাদেরকে বিশ্বাস করত তাহলে নিশ্চয়ই সেদিন সানুকে জীবন দিতে হতো না। আসলে কি ওরা আমাদেরকে মানুষই ভাবে না। তোমরা কেন যে মিছেমিছি পাকিস্তানের নাম মুখে নিস। ইমান নিয়ে বাঁচতে চাস তো দালালি বাদ দিয়ে গ্রামের মানুষের জন্য কিছু কর।
বেশ কিছু দিন পরের এক হাট বার। গ্রামের মানুষ হাটে গেছে। রাজাকারের দল গ্রামে ঢুকে মুন্সি বাড়িতে হানা দিল। মুন্সির জামাই এবং ছেলে আগেই ইন্ডিয়া গেছে। বাড়িতে শুধু মহিলারা ছাড়া আর তেমন কেউ নাই ।
রাজাকার নেতা আলতু মিয়া মুন্সি বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষকে না পেয়ে কি একটা বিশ্রী ভাষায় গালি দিল সে। তারপর অন্দরের দিকে একটু গলা বাড়িয়ে বলল, পাকিস্তানের গোলামী করা কি আর ভাগ্যের কথা। কত জনই তো এই পাক-পবিত্র দেশের জন্যি মরতে চায়, কিন্তু পারে না। আর পাকিস্ত গানের জন্যি মরলে নিশ্চিত বেহেশত পাবে।
আলতু মিয়ার পিছনে থাকা তাজু মিয়া বলে উঠল, হ... হ... কপালের লেখা। ইন্ডিয়ার দালালি করে দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ দেওয়ার কি কাজ আছিল ।
এমন সময় মুন্সি পরিবারের অন্দর মহল থেকে নিচু কাঁপা গলায় কে একজন বয়সী মহিলা বলল, আমরা অবলারা ভিতরে আছি গো বাবা, এহানে কোনো পুরুষ মানুষ নাই। তোমরা এদিকে আর আস না । আলতু মিয়া উৎস্যুক হয়ে এগিয়ে গেল। একজন বয়সী মহিলা তিন-চারজন
বাড়ন্ত মেয়েকে আগলে রেখেছে ।
আলতু মিয়া আরো একটু এগিয়ে বলল, মুন্সি কোন হ্যায়। জবাবের অপেক্ষা না করে আলতু মিয়া ছোটটির হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিল। আর মেয়েটি
বয়সী মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, মাগো, বাঁচাও । আলতু মিয়া মেয়েটির পড়নের কাপড় ধরে জোরে টান মারলে মেয়েটির পরনে থাকা কাপড় ছিড়ে মেয়েটি বে-আবরু হয়ে গেল। তবুও সে তার মাকে
জড়িয়ে ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করল।
আচমকা এই ঘটনায় অন্য মেয়েগুলো জড়সড়ো হয়ে গেল। এরি মাঝে একজন মেয়ে সাহস করে রান্না ঘরের বটি নিয়ে এগিয়ে এলো।
আলতু মিয়ার পিছনে থাকা তালুর এক গুলিতে মিয়েটির মাথার খুলি উড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে ঘিলু সুদ্ধ এক থাপলা রক্ত ছিটকে পড়ল। মেয়েটি চিৎ হয়ে পিছন দিকে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। অন্য দু'টি মেয়ে হুমড়ি খেয়ে ওর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। বয়সী মহিলাটি জ্ঞান হারালো। আলতু মিয়া
টেনে হিচড়ে মেয়েটাকে ঘরের কোণায় নিয়ে গেল। এই বারো কি তের বছর বয়স হয়েছে তার। বাড়ন্ত দেহ ঢাকবার কোনো চেষ্টাই করল না সে। শুধু দু'হাতে মুখ ঢেকে বিলাপ করতে লাগল।
আলতু মিয়া জোর করে মুখ থেকে হাত সড়ানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি প
করে এক খাপলা ছ্যাপ আলতু মিয়ার মুখে ছিটিয়ে দিল।
আলতু মিয়া নিজ জামায় ছ্যাপ মুছতে মুছতে বলল, মাগীর ত্যাজ কত্ত। মুন্সি বাড়িতে খেয়ে এড়ো চেহারা নিয়েছে।
এত্তটুকু মেয়ে মনে হয় কলজের ভয় সরে গেছে। কড়া গলায় বলল, ওরে নিমক হারাম । তুই তো পাকিস্তানের দালালি করছিস। খোদা তোকে আর কি বুদ্ধি দিবে এই বলে মেয়েটি উঠার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
আলতু মিয়া তার ডান পা মেয়েটির বুকে তুলে দিয়ে মেয়েটিকে মাটির সাথে চেপে ধরল।
মেয়েটি জোর গলায় বলে, জেনে রাখিস পাপীর দল, মুন্সি বাড়ির ছোট মেয়ে খাদিজা-তুল-কুবরার সম্ভ্রমের মত হাজার নারীর সম্ভ্রম এই বাংলাদেশ। আর এই সম্ভ্রমকে কেউ কোনোভাবে বিনষ্ট করতে পারে না। একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে।
তারপর মেয়েটা একটা ঢোঁক গিললো। কাঁপা গলায় বলল, জারজ, বে-ইমান তোদের ক্ষমা নাই। ক্ষমা না...ই...।
আলতু মিয়া হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঠিক বুকের মাঝখানটায় রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালায়।
খাদিজা-তুল-কুবরা হাত-পা ছড়িয়ে দাপাদাপি করে। ফিনকি দিয়ে বুকের মাঝখানটা থেকে রক্ত বেরোয়। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শরীরটা। দু' হাত বুকের উপর রেখে বাড়ন্ত সম্ভ্রমকে সামলানোর চেষ্টা করে সে।
২৮/১২/২০১৪ ইং
রবিবার