রম্য রচনা
এই ফেসবুকের গতরে আজ আমি যা লিখছি তা যদি কোন বিদগ্ধ পণ্ডিতের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে তিনি চোখদুটো কপালে তুলে বলবেন, আহা! তালগাছের তলে ইস্কুল হলে কলিমউদ্দির ছেলে যেমন মাস্টার হয় তেমনি ফেসবুক বুক চেতিয়ে বসে আছে বলে যদু মধুও লেখক বনে গেছে। কী তার লেখার ছিরি আর কী তার বিষয়বস্তু।
তা বৈদগ্ধকলুষ বিদ্বজ্জনেরা যাই বলুন আমি রক্তমাংসের মানুষ তাই আমার প্রাকৃতিক,প্রায়োগিক এবং হার্দিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতেই পারি। যা হোক, গৌরচন্দ্রিকার কলেবর না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি।
বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে সম্ভব অসম্ভব সব বিষয়েই ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সকল উন্নয়নের বিষয়ে কমবেশি আলোচনা হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্নয়ন সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন আলোচনা আমার চোখে পড়ে নি। আর সে বিষয়টি হল মূত্রাগার ও মূত্রকরের উন্নয়ন।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এ বিষয়ে আমি এই অবহেলিত ক্ষেত্রটি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।
আমি ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্র তখন আমার বন্ধু মিরু রামকৃষ্ণ মিশন রোডে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে পড়তো। প্রায় প্রতিদিন বিকেল বেলায় আমরা শহরের বিভিন্ন এলাকা পায়ে হেঁটে বেড়াতাম।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে দু বন্ধু পলাশীর মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন পর্যন্ত চলে গেলাম। হঠাৎ মিরু বলল, এই, আমার খুব পেচ্ছাব চেপেছে। আমি বললাম, কোথাও চুপেচাপে ছেড়ে দে। আমার চাইতে ওর লজ্জা শরম একটু বেশি বা জনবহুল শহরে চুপেচাপে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলে মিরু আমার প্রস্তাবটি আমলে নিল না। তবে আমরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম কোন জায়গা পাওয়া যায় কি না। হঠাৎ চোখে পড়ল পরিত্যক্ত রেলভবনের দেয়াল ঘেঁষে চটের বেষ্টনী দিয়ে গণমূত্রাগার তৈরি করা হয়েছে। আমি মিরুকে সেদিকটায় ইশারা করতেই সে দড়ি ছেঁড়া ষণ্ডের মত সেদিক ছুটে যেতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর প্রকৃতির চাপ থেকে মুক্ত হয়ে যখন বেরিয়ে এলো ঠিক তখনই মূত্রকর আদায়কারী ওর সামনে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল, দশ পয়সা দেন।
মিরু বলল, পয়সা কেন?
লোকটি বলল, কেন দেখছেন না? চট, বাঁশ,দড়ির খরচা আছে না?
মিরু বলল, ভাই আমি খুব সামান্য ত্যাগ করেছি। পাঁচ পয়সা দিলে হয় না?
আমি দেখলাম ব্যপারটা অন্যদিকে যাচ্ছে। দ্রুত দশ পয়সা ওয়াশিল করে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। কেননা এটা আমাদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা এবং এমন যে যা নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ নেই।
জীবনে এই আমি প্রথম দেখলাম প্রাকৃতিক কর্ম করতেও ফিস দিতে হয়।
এ ঘটনার অনেকদিন পর আমি একদিন মহাখালী বাস টার্মিনালে যাই। বাসের টিকিট কেটে ভাবলাম ময়মনসিংহ পৌঁছতে তো অনেক সময় লাগবে পাছে পথে প্রকৃতি তাড়া করে তাই সলিলনিঃসরনের কর্মটি সেরেই ফেলি। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি উত্তর দিকে ইশারা করলেন। আমি ভেবেছিলাম সরকারি উদ্যোগে জনস্বার্থে হয়তো কোন ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু গিয়ে দেখলাম, না, সেই চটের বেষ্টনী। নিঃসরন কর্ম শেষে কর আদায়কারী যে একটা টোলের উপর বসেছিল সে আমার কাছে চার আনা মানে পঁচিশ পয়সা দাবি করল। আমি তাঁকে একটা আধুলি দিলাম। সে আমাকে খুচরো দিতে পাচ্ছিল না। চার আনার কী বিহিত হবে তা অনিশ্চিত রেখেই আমি বাসের কাছে চলে এলাম।
এসে দেখি আমার প্রতিবেশি প্রদীপ বাবুও আমার সহযাত্রী। বললাম, দাদা, যাবার আগে গুদাম খালি করা দরকার না? রসিক প্রদীপ বাবু আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, ঠিক কইছেন।
আমি বললাম, তাহলে আসুন আমার সাথে। তিনি বললেন, না না, আপনার যেতে হবে না।
সেখানে যে কি কাহিনি আছে সেটা তো আর প্রদীপ বাবু জানেন না। আমি তাকে সাথে নিয়ে গিয়ে মূত্রকর আদায়কারীকে বললাম, এই যে ভাই, আমার পাওনা চার আনার বদলে ইনি ত্যাগ করবেন। টোলে বসা লোকটি শুধু হাসলো।
তারপর কিছুদিন যেতে না যখন যেতেই দেখলাম সারা বাংলাদেশের মসজিদ,রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড, বাস টার্মিনাল সহ যেখানে যেখানে সুযোগ আছে তার সবখানে মূত্রাগার ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে।
এখানে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বলছি। একবার আমি শহরের কাঁচা বাজারে গেছি। হঠাৎ সলিল তপ্ত হয়ে চাপ দিতে শুরু করল। আমি বাজারের এক প্রান্তে মসজিদে গেলাম। নিঃসরণ কর্মশেষে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসা আদায়কারীকে বললাম, কত?
তিনি বললেন, তিনটাকা
আমি তাকে দুটি দু টাকার নোট দিলাম। তিন আমাকে বললেন, একটাকার খুচরো নেই।
আমি বললাম, তাহলে দুটাকা নিন।
না, তিনি দুটাকা নিবেন না।
অগত্যা আমি বললাম, ভাই, আমি আর কিছুক্ষণ আপনার এখানে বসি।
তিনি বললেন, কেন?
বললাম, কিছুক্ষণ বসলে একটাকার বিনিময়ে ত্যাগ করার মত তরল তলপেটে জমা হয়ে যাবে। তখন পাওনা টাকাটা ওয়াশিল করেই আমি চলে যাব।
লোকটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলল, জীবনে বহু মূত্রক দেখেছি কিন্তু আপনার মত এমন হিসেবি মূত্রক আর কখনও দেখি নি। হাসতে হাসতে তিনি আমাকে দুটাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ভাইসাব, আপনি আবার আসবেন। আপনার জন্য ফ্রী।
আমি বললাম, না তা হবে কেন? মসজিদের উন্নয়নে আমি অবশ্যই অংশীদার হব।
সেই দশ পয়সা দিয়ে যে অভিজ্ঞতার সূত্রপাত সে
অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রটি এখন বাংলাদেশে সর্বত্র প্রসারিত হয়েছে। দশ পয়সা থেকে চার আনা আট আনা একটাকার মূত্রকর এখন চিন্তা করা যায় না। এখন পাঁচ টাকা দশ টাকা পর্যন্ত আদায় হচ্ছে।
অবশ্য মূত্রাগারগুলিরও উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশে এখন মূত্রালয় স্থাপন একটি লাভ জনক ব্যবসা। যত্রতত্র সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে মূত্রালয় স্থাপন করে তা ইজারা দেয়া হচ্ছে। অবশ্য ইজারা দেয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
দিনকতক আগে আমি জামালপুর টাউন জংশনে ময়মনসিংহের ট্রেন ধরার জন্য যাই। দুপুরের ভুঁড়িভোজটি উদরের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ায় সঙ্গতকারণেই সলিলনিঃসরণবেগ ত্বরান্বিত হবার কথা। ট্রনের সময়সূচি মত স্টেশনে এলেও ট্রেনটি আসে নির্ধারিত সময়ের একঘন্টা পর। স্টেশনে পায়চারি করতে করতে এক সময় অনুভব করলাম আমাকে প্রকৃতি ডাকছে। কোথায় যাব ভাবছি। কেননা ইতরপ্রানির মত যেখানে সেখানে তো আর বসা যায় না। হঠাৎ চোখে পড়ল প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষে বিজ্ঞাপন সাঁটা হয়েছে। এখানে অমুক তমুক করা যায়। আমি বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মূত্রাগার।
আমার কাছে দশ টাকা দাবী করা হল। আমি দশটা টাকা দিলাম বটে তবে টাকার শোকে আমার তলপেট থেকে বক্ষপিঞ্জর পর্যন্ত রিরি করে উঠল। মনকে বুঝালাম, ভেবে আর কী হবে। মানুষ কথায় বলে, মুখের কথা, বন্দুকের গুলি এবং নিঃসৃত সলিল একবার বেরোলে আর ঢুকানো যায় না।
আমি বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো কেন উপস্থাপন করলাম তার একটা কারণ আছে। আর সেটাই এখন বলছি।
মূত্রকর আদায়ের ক্ষেত্রে দেশে ব্যাপক অব্যবস্থাপনা চলছে। কোথাও পাঁচ টাকা কোথাও দশ টাকা কোথাও বা স্বেচ্ছা নির্ধারণ।
যেহেতু বিষয়টি জনসেবামূলক তাই মূত্রাগার সমূহের উন্নয়নের স্বার্থে এটি নিবন্ধনের আওতায় আনা দরকার। তা না হলে নিঃসরণকারীদের ভোগান্তির সীমা থাকে না।
যেমন কোথাও বাণিজ্যিক মেলা, লোকমেলা বা ওরস শুরু হলে তার আশেপাশে বহু মূত্রাগার তৈরি করা হয়। সে সব মূত্রাগার কোনভাবেই মান সম্মত নয় অথচ গলাকাটা কর আদায় করা হয়।
তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাহাদুর যদি মূত্রাগার সমূহের নিবন্ধন এবং সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একটি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে তাহলে এক্ষেত্রে যাচ্ছে তাই অবস্থা আর চলবে না।
দেশে তো প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেক পরিদপ্তর অধিদপ্তর রয়েছে। জাতীয় প্রয়োজনে একটি মূত্রকর নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর স্থাপনে তো অসুবিধা থাকার কথা নয়।
সেই অধিদপ্তর মূত্রাগার সমূহে কত টাকা কর আদায় করা যাবে তা নির্ধারন করবে।
এই বিষয়টির সাথে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক আছে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে মূত্রালয় স্থাপন করে ইজারা দেয়ায় ইজারাদারগণ ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে। মান সম্মত মূত্রাগার পরিচালনায় দুজন কর আদায়কারী, একজন ইনস্পেকটর, তিনজন পরিচ্ছন্নকর্মী যদি নিয়োগ করা হয় তাহলে সারাদেশে হাজার হাজার মূত্রাগারে লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্ম সংস্থান হবে।আর পুরো কাজটি নিয়ন্ত্রণ করবে মূত্রকর নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
পরিশেষে আর একটি কথা বলে রাখি। ছোটবেলায় শুনেছি জাভা দ্বীপে মূত্র সংরক্ষণ করে না কি চিনি তৈরি করা হয়। কেননা মূত্রে সুগার আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যদি মূত্রবিজ্ঞান নামে একটি ডিপার্টমেন্ট খোলা যায় তাহলে মূত্র থেকে চিনি উৎপাদনের বিষয়টি সেখান থেকে পাশ করা বিশেষজ্ঞগণ সহজেই দেখতে পারবেন। দেশেও চিনির অগ্নিমূল্যে শ্রাবণের বারিবর্ষণ হবে।
অনেকেই বলবেন, মূত্র থেকে চিনি উৎপাদন হলে আখ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং চিনি কলগুলো বেকার হবে। তবে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চিনি কলগুলো লোকসানের অতলসাগরে বছরের পর বছর সন্তরন করছে।
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
ময়মনসিংহ
০৯/৯/২০২৩