চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তুপ তবে আবার কেন ফিরে এলো নিশি ? কে তাকে ফিরিয়ে আনলো ? আবার এ-ও তো সত্য সব ফিরে আসার মানে যবনিকা নয় বরং ফিরে ফিরে আসতে হয় আবার ফিরে যেতেও হয় । এই আসা যাওয়ার সুতোয় গাঁথা হয়ে থাকে একটা কষ্ট একটা টান । একটা পাওয়া না পাওয়ার দোল একটা কিছুর জন্য হায় হায় হতাশা । সে কারণেই নিশি হয়তো আরো একবার ফিরলো । ফিরলো খুঁজে পেতে ছেনে ছুঁয়ে দেখতে তার নিরন্তর বাসনাকে । তাকে ছেড়ে যাওয়া মুনিয়া পাখিটা যেমন মাঝে মাঝেই ফিরে আসে তার চেনা ঠিকানায় ।
নিশি মুনিয়ার খাঁচাটা তেমনি ঝুলিয়ে রেখেছে সে আশাতেই যে মুনিয়া আবার ফিরে আসবে । এসে কিছুটা সময় কাটাবে তার বেড়ে ওঠার বসতিতে । আবার ওড়েও যাবে তার পাখনার স্বাধীনতা নিয়ে । এমনি আসা যাওয়া বিরতিহীন ভাবে চলবে । তারপরও পাখিকে কেউ উদ্বাস্তু বলেনা অথচ মানুষ উদ্বাস্তু হয় । হতে বাধ্য হয় ।
মানুষের অন্তিম আকাঙ্খা একটা ঘর । সেই ঘরই তার পৃথিবী । সে সমস্ত জীবনীশক্তি দিয়ে সাজিয়ে তুলে সেই ঘর । একটি সুশ্রী ঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে তার স্বপ্ন । স্বপ্ন ! স্বপ্নই তো পাখির মতো ওড়ে । নিশির স্বপ্ন আর তার মুনিয়া পাখি একই । উভয়ই বৃক্ষ চেনে । কিন্তু ঘরহারা মানুষ খুঁজে ফেরে আর একটা
ঘর । ঘরহারা মানুষকে গৃহী মানুষেরা বলে উদ্বাস্তু ।
উদ্বাস্তুদের ঘর খুঁজার আকুতি নিশি দেখেছে । তাদের চোখের চাহনী , পায়ের চলন , তার আপন জনদের আকড়ে থাকার হাত সবই ভিন্ন ।
তাদের গৃহ কেড়ে নেয় যারা তাদের আস্ফালনও নিশি দেখেছে । ওরা নিষ্ঠুর । ওদের হাসি ক্রঢ় । ওদের চলার পথও স্বাভাবিক নয় । সেপথ সুরঙ্গপথ । শতশত সুড়ঙ্গ পথে এদের চলন । বস্তুত এরাই আপাত বিজয়ী ।
নিশির ভাবনায় এখন আর কোন গন্তব্য নেই । আছে উৎকণ্ঠা। আছে ইদ্রিস আলীকে নিয়ে স্বপ্নশূণ্য চোখে তাকিয়ে থাকা ।
এ ভাবনায় মিশে আছে দারিদ্র্য । ওরা বলে দরিদ্রদের ভাবনায় নানা ধরনের দূষণ থাকে । থাকে আত্মকেন্দ্রিকতা । থাকে অনিরপেক্ষতা । কী নির্মম ওদের ভাবনা । অনির্দিষ্টকালের এ ভাবনা নিয়ে নিশি বেরিয়ে আসে অতি অস্তিত্বময় ঘর থেকে । কিছুটা সময় সে ভুলে যায় কঠিন কঠোর বাস্তবতাকে । সে মুনিয়া পাখির অজুহাতে ঘুরে বেড়ায় । উদ্বাস্তুদের ভিড়ে হারিয়ে যায় ।
নিশির ধারণা এরা শুধু গৃহহীন নয় এরা ধর্ষিত , এরা অর্ধমৃত , এরা প্রহৃত এরা অগ্নিদগ্ধ এরা ভাসমান ।
এরা হারিয়ে ফেলেছে জাতীয়তাবোধ , রাজনৈতিক আদর্শ এরা নিরাপত্তাহীনতায় সর্বদা কম্পমান ।
নিশির শরীরে মাতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট কিন্তু নিশি একে মাতৃত্ব বলেনা । এটা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভস্ফীতি । শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের স্ফীতিগুলো কিছুতেই আর ঢেকে রাখতে পারছেনা নিশি । ইদ্রিস আলী জানেনা তার স্ত্রীর গর্ভস্ফীতি ঘটেছে । এ এক অমিমাংসিত বিচ্ছেদ । ওরা ওই আপাত বিজয়ীরা তাদের বিচ্ছিন্ন করেছে । প্রথম প্রথম মরে যেতে ইচ্ছে হতো । কিন্তু মরে যেতে পারছেনা নিশি । একি শুধু নিজ প্রাণের মায়া ! নাকি তার অস্তিত্বের ভেতর থেকে কেউ তাকে আগলে রাখে ! এখন সে যে বীরদর্পে জানিয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতি । তার নাড়ির সারবস্তু শোষণ করে বেড়ে উঠছে যে সেকি তার আপন কেউ ! সেই কী মায়া লাগিয়েছে !
ইদ্রিস আলীর প্রতি অভিমানটা এখন ক্ষোভে পরিনত হয়েছে নিশির । গ্ৰামরক্ষা কমিটির নেতা হয়ে গ্ৰামকে কী রক্ষা করতে পেরছে সে ? সে এখন ওদের কাছে উগ্ৰপন্থী সন্ত্রাসী নামে পরিচিতি পেয়েছে । নিজের স্ত্রীকে বলতে গেলে ওদের হাতেই তুলে দিয়েছে সে । ওরা ইদ্রিস আলীর খোঁজে আসে । ঘরে তল্লাশি
চালায় । ইদ্রিস আলীকে না পেয়ে হিংস্রবাঘ হয়ে ওঠে । হিংস্র বাঘেরা ঝাপিয়ে পড়ে নিশির উপর । ওরা দলবদ্ধ পশু । যেন ইদ্রিস আলীকে না পাওয়ার ক্ষোভ ওরা সুদে আসলে আদায় করার প্রতিযোগিতায় নামে ।
নিশি হাল ছেড়ে দিয়েছে । বাগে পেলে শিকারি তো শিকার করবেই ।
দেখতে দেখতে গ্ৰাম উজাড় । ধ্বংসস্তুপের মাঝে দুচারটা ঘর দাঁড়িয়ে আছে । এগুলো ওদের শিকার ধরার টোপ । ওসবের একটাতে নিশিকে ওরা বাঁচিয়ে রেখেছে । নিশি বেঁচে আছে এই বিভীষিকাময় স্বপ্নের ঘোরে । একদিন ফিরে আসবে ইদ্রিস আলী । আবার আগের মতো তার স্বপ্নের ঘর রঙিন হয়ে উঠবে । এই ক্ষয়িঞ্চু ঘরের টানেই সে ফিরে আসে বারবার ।
ঘোর কেটে যায় নিশির । এইমাত্র ওরা বুঝিয়ে দিয়েছে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে । সে দেখতে পাচ্ছে ঘরের উত্তর পশ্চিম কোনে একটা আলো । রাতের অন্ধকারে এ আলোর ছটা নিশির চেনা । শিকার নাগালে পেলেই ওরা এ আলো ছড়িয়ে দেয় । ইদ্রিস আলীকে ওরা পেয়ে গেছে । দূরে একটা গুলির আওয়াজও শুনেছে নিশি । আলোটা ততক্ষণে লেলিহান আগুনে রূপ নিয়েছে । নিশির আর পিছুটান নেই ।
নিশির দৃষ্টিতে এখন ওই উদ্বাস্তুদের মতোই জ্বালা , ওর হাত কোন আপনজনের প্রত্যাশায় প্রসারিত নয় , ওর সর্বশরীর কলুষিত । তবুও একটা আশ্রয় চায় নিশি ।
সামনে অথৈ সাগর । সুদন মাঝির নৌকায় লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে বসছে সবাই । নারী পুরুষ শিশু কিশোর সবার যাত্রাই গন্তব্যহীন । নিশি পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে আছে । নিশির পায়ের নিচে আছড়ে পড়ে সাগরীয়
ঢেউ । তার ভারি দেহটা তাল সামলাতে পারেনা । পরনের শাড়িটা টেনেটুনে ঢাকার চেষ্টা করে শরীরের বাড়ন্ত ঔরস ।
অজানা এক টানে বারবার পেছন ফিরে তাকায় সে । তার ঘরসংসার নেই । আপনার জন বলতে কেউ নেই । সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । ধ্বংসের খেলায় ওরাই আজ বিজয়ী । মুনিয়ার শখের খাঁচাটাও আর নেই । তবুও হয়তো আসবে মুনিয়া । ঘুরে ঘুরে খুঁজে ফিরবে ওর বেড়ে ওঠার বসতি । মুনিয়ার মতো নিশির কান্নায়ও ভীষণ ভাবে ছড়িয়ে আছে একটা ময়াজাল । সে মায়া কোনদিন কোনকালেই ছিন্ন হবার নয় ।
নিশি খুব কষ্টে তার ভারি দেহটা টেনে তুলে , ওঠে বসে নৌকার পাটাতনে । এখন থেকে তার একটাই পরিচয় - সে উদ্বাস্তু ।
২০ জুন , ২০২২ ইং