শ্মশানের বিভীষিকা ।। সন্দীপ মজুমদার

 

কুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে ও আমার বাম দিক থেকে ডান দিক আর ডান দিক থেকে বামদিকে ঘোরাফেরা করছে বলে প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্মশানটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল। এবার খুব অস্পষ্টভাবে কুকুরটা আমার দৃষ্টিগোচর হল। মনে হল ও আমাকে একবার করে পাক খেয়ে পিছনের রাস্তায় ওকে অনুসরণ করার জন্য ইঙ্গিত করছে। তখন আমি নড়াচড়া করার ক্ষমতা ফিরে পেলাম, আর ধীরে ধীরে আমি আমার সামনে চলা কুকুরটাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। একটু পরেই শ্মশানের রাস্তা ছেড়ে আমি আগের রাস্তায় ফিরে এলাম। এবার কুকুরটা আরও কিছুটা স্পষ্ট হল। তার গায়ের রঙ পুরোটাই কালো বলে মনে হল। তাই এতক্ষণ ওকে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলাম না। কুকুরটা ডান দিকে ঘুরে আমাকে জাতীয় সড়কের দিকে নিয়ে যেতে থাকল। বেশ কিছুটা হাঁটার পর জাতীয় সড়কে গাড়ি চলাচলের শব্দ শুনতে পেলাম। আর সেইসঙ্গে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম। মনে মনে খুব আনন্দ পেলাম। আমার ইষ্ট দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। তখন কিছুক্ষণের জন্য আমার মনটা বিচলিত হয়েছিল। কিন্তু এবার সামনের দিকে তাকিয়ে কুকুরটাকে ভাল করে লক্ষ্য করতে যেতেই দেখলাম আমার ধারে কাছে কোথাও কোনও কুকুর নেই। কয়েকবার পিছনের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, "আয় ভুলুউউ আয়...।" কিন্তু আমার ডাকে সাড়া দিয়ে ভুলু এবার আর আমার কাছে এল না। যখন ভাবছি কোথায় গেল ভুলু? ঠিক তখন থেকেই আমার শরীরটা ক্রমশই অবসন্ন হতে থাকল। মনে হচ্ছিল কোনওমতেই আর হাঁটতে পারবো না। তবুও অনেক কষ্টে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে জাতীয় সড়কের কাছে এসে দাঁড়ালাম। গাড়ির আলোয় ঘড়িতে দেখলাম রাত তখন আড়াইটা বাজে। হতবাক হয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, এতটা সময় কোথা দিয়ে অতিবাহিত হল? এতো রাতে এইসব জায়গায় রিক্সা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই খুব ধীর পায়ে বামদিকে কিছুটা হেঁটে ওটি রোড (ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড) ধরলাম। রাস্তার দু'পাশের সমস্ত দোকানপাট অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘন কালো আঁধারের মধ্যে দিয়ে একা আমি হেঁটে চলেছি। এভাবে আরও বেশ কিছুটা হাঁটার পর থানার মোড়ে পৌছলাম। এবার লক্ষ্য করলাম দূর থেকে একটা সাইকেল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। সাইকেলে যিনিই থাকুন আমি তাঁকে আমায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব। সাইকেলটা আমার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠে দেখলাম সাইকেলের আরোহী আর কেউ নয়, আমারই দাদা। রাত পর্যন্ত বাড়ি না ফেরায় দাদা আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আমাকে দেখে দাদা সাইকেল থেকে নেমে আমার গায়ে হাত দিয়ে আমি ভাল আছি কিনা পরীক্ষা করতে করতে বলল, "তোর গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!" তারপর দাদা আমাকে কিভাবে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে সেটা আমার আর কিছুই মনে নেই। পরদিন সকাল ১০ টা নাগাদ আমার ঘুম ভাঙল। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার মা উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ঘরের মধ্যে আমার বাবা, দাদা ও আমার সেই তিন বন্ধুকেও দেখতে পেলাম। দাদা বলল, গতকাল রাতেই আমার বন্ধুরা বাড়িতে এসে আমার খবর দিয়েছিল। তারপর থেকেই দাদা সাইকেল নিয়ে সর্বত্র খুঁজেও আমার দেখা পায়নি। তাই যখন দাদা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঠিক তখনই তার সঙ্গে আমার থানার মোড়ে দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমি বিছানায় শুয়েই আগের দিনের ঘটনাগুলো একে একে স্মরণ করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আমার উদ্ধারকারী সেই কুকুরটা কিভাবে ওই রাতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কে তাকে পাঠিয়েছিল সেটাও অনুধাবন করতে পারছিলাম না। তখন মনে পড়ছিল আমি আমার বন্ধুদের একবার বলেছিলাম, "আমাদের কিছু হলে স্বয়ং মহাদেব আমাদেরকে রক্ষা করবেন।" আর প্রাচীন শিব মন্দিরটার কাছ থেকেই কুকুরটার আবির্ভাব ঘটেছিল। আমাদের জীবনে এই ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। যেগুলো আমাদের স্বপ্নের অতীত তো বটেই, বলা চলে দুঃস্বপ্নেরও অতীত।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)



লেখক পরিচিতিঃ- নাম- সন্দীপ মজুমদার
পেশায় সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
ঠিকানা- পোস্ট অফিস ও থানাঃ- বাগনান
জেলাঃ- হাওড়া
দেশঃ- ভারতবর্ষ
রাজ্যঃ- পশ্চিমবঙ্গ
পিন কোড নম্বরঃ- ৭১১ ৩০৩


Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।