সন্তান ।। আব্দুর রাজজাক বকুল



কলেজ থেকে ফিরেছি শেষ বিকেলে। বাসায় এসে তড়িঘড়ি করে বাথরুম সেরে ডাইনিং টেবিলে বসতেই খালাতো বোন মিরা এগিয়ে এলো সামনে। মিরা পাতে ভাত বেড়ে দিতে দিতে হাসি হাসি মুখে বললো, ভাইয়া, আগাবেলা শ্রাবন্তী বৌদি এসেছিলেন এখানে। তোমাকে ডেকে গেছেন জরুরী ভিত্তিতে। বলে গেছেন, তুমি কলেজ থেকে ফিরলেই যেন পাঠিয়ে দিই।

উত্তর আরামবাগে থাকেন শ্রাবন্তী বৌদি। খালার বাসা থেকে কোয়ার্টার কিলোর বেশি হবে না ব্যবধান। শ্রাবন্তী বৌদি প্রায় আমার সমবয়সী। তার স্বামী অসীম সাহার সাথে আমার জানাশোনা অনেকদিন আগে থেকে। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে অনার্সে যখন নতুন ভর্তি হই তখন থেকে। বছর তিনেক আগে শ্রাবন্তী বৌদিকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন অসীম দা। অনেকবার গিয়েছি ও বাসায়। জরুরী প্রয়োজনে কাউকে দিয়ে আমাকে ডেকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু বৌদি নিজে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন, এমন ঘটনা একবারও ঘটেনি এই দীর্ঘ তিন বছরে। সঙ্গতঃ কারণেই মিরার কথাটা অন্যরকম মাত্রা পেল আমার কাছে। 

দরজা খুলে দিয়ে বৌদি হাসিমুখে বললেন, ডেকে এসেছি সেই আাগাবেলা। আর মাত্র এই ভর সন্ধ্যায় এলে? 
আমি অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে বললাম, তুমি ডাকলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে আসা যায় না। বাজার করা, প্রাইভেট পড়া, কলেজ কতো কাজ! তাও বলো আসতে পেরেছি। 
বৌদি মুখ ভেংচিয়ে বললেন, ইস্ কী আমার কর্মী ছেলে রে! ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সুন্দরী মেয়েদের সাথে সারাদিন যে গুল্লি মারো সে খবর বুঝি রাখি নে? 
আমি জিহ্বায় দাঁত কেটে বললাম, তওবা তওবা, কী যা তা বলছো বৌদি! এক তোমার বোন ছাড়া এ জীবনে আর কোন মেয়ের দিকে তাকিয়েছি? তুমিই বলো? তোমার গুণধর বোন জয়ত্রী সুন্দরী কবে আসছে গো?
বৌদি ভ্রু দুটো টান করে বললেন, কেন, তর বুঝি সইছে না?
‘তোমার খালি ফাজলামো। প্লিজ, বলো না গো কবে আসছে?’
বৌদির দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে, আসছে গো আসছে। এবার দোলের মেলায়। 
‘ইস্, সে তো আরও পাক্কা দু’মাস!’
বৌদি হেসে ফেললেন, দু’মাস কী এমন সময় ? এতোদিন অপেক্ষা করলে। আর মাত্র দু’মাস পারবে না? এতোটা কম ধৈর্য হলে কী চলে?
‘আচ্ছা সে না হয় হলো। এখন বলো না, এবার জয়ত্রী এলে ওর সঙ্গে আমাকে মেলায় যেতে দেবে?’
‘না গো মশাই সেটি হবে না।’
‘কেন গো বৌদি?’
‘তোমার যা স্বভাব! বোনকে তোমার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো ভেবেছো?’
‘ইস্ আমি বুঝি জন্তু-জানোয়ার?’
‘জন্তু-জানোয়ার হতে যাবে কেন? তবে তুমি খুব সাধু ছেলে না। সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখলে যেরকম নাক ফোঁস ফোঁস করো!’
‘এখনও তো তোমাকে দেখেছি। সুন্দরী মেয়ে মানুষকে দেখছি। এখনও কী নাক ফোঁস ফোঁস করছি?’
‘করছোই তো। কানটা তো গরম করে ফেলেছো। হাত দিয়ে দেখো না। ’
বৌদির কথা মতো আমি কানে হাত দিলাম। না, কান ঠান্ডাই আছে। বুঝলাম বৌদি আমার সাথে দুষ্টুমি করছেন। আমি লজ্জিত কণ্ঠে বললাম, যাও তুমি ভীষণ পাজি হয়েছো। 
আমার কথা শুনে বৌদি হেসে ফেললেন। 

মূল দরজা লাগিয়ে দিয়ে বৌদি ড্রইং রুমের দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমি উৎসাহ হারালাম না। পেছন পেছন যেতে যেতে বললাম, গত মাসে  তো বাপের বাড়ি গিয়েছিলে। জয়ত্রী সুন্দরী এখন কেমন আছে গো? খুব মোটা হয়েছে? ইস্ কতোদিন ওকে দেখি না! আচ্ছা, ওর ডান গালে তো মস্ত একটা ব্রণ উঠেছিলো, সেটার অবস্থা কী? 
‘ওটা তো কবেই সেরে গেছে। তার জন্য কতো কী ওষুধ মেখেছে!’
‘তাহলে তো জয়ত্রী এখন দেখতে সাক্ষাত রাণী মুখার্জীর মতো হয়েছে। হয়েছে না?’
বৌদি চিকন হাসি দিয়ে বললেন, তাতো হয়েছেই। এতে তোমার এতো আগ্রহ কেন শুনি?
বৌদির মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে আমি ঈষৎ গাল ফুলিয়ে বললাম, আমার আগ্রহ কেন মানে? আমি ছাড়া তোমার বোনের কোন গতি আছে নাকি? 
এবার একটু সিরিয়াস হতে চেষ্টা করলো বৌদি, তুমি তো মুসলমান। ওকে বিয়ে তো করবে না। 
আমি দুষ্টুমির ছলেই বললাম, তা না হয় নাই করলাম। একটু ইয়ে টিয়ে.......। 
বৌদি খেদোক্তি করলেন, আহা, নাগরের আমার শখ কতো! বিয়ে না করে ইয়ে টিয়ে.......। 
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম, বারে তাহলে তোমার বোন থেকে আমার কী লাভ হলো?
‘লাভ লোকসানের হিসেব করো না। শোনো, খবর খারাপ আছে।’
‘কী খারাপ খবর গো?’
‘শুনলাম ও নাকি কার সাথে প্রেম ট্রেম করে বেড়াচ্ছে। যে কোন সময় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে টিয়ে করে ফেলতে পারে। তোমার কপালে মুড়ো ছাড়া আর কিছু জুটছে না।’
আমি চোখ পিটপিট করে বললাম, বলো কী, এতো দূর! আমার এখন কী হবে গো?
‘তোমার আর কী হবে। বসে বসে আঙ্গুল চুষবে........।’
বৌদি হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেলেন। আমি টিভি ছেড়ে দিয়ে একটা ইংরেজি সিরিয়াল দেখতে লাগলাম। 

প্রায় ঘন্টা দেড়েক পার হয়ে গেলো। বৌদি আমার সামনে ট্রেতে করে বিস্কিট, কলা, পাউরুটি, চানাচুর এসব রেখে সেই যে ভেতরে গেলেন আর আসার নাম গন্ধটিও নেই। কাজের পিচ্চিটাকেও দেখলাম না। সমস্ত বাড়িটা কেমন যেন নীরব নিথর। আমি অন্য কোন চিন্তা না করে টিভির দিকে মনোনিবেশ করলাম। স্টার মুভিজে ‘হারকিউলিস’ চলছে। আমি অত্যন্ত আগ্রহ দিয়ে সিনেমা দেখছি। খানিকক্ষণ পরে আমার কাঁধের কাছে নরম একটা স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বৌদি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন আমার বসার পেছনের সোফা ঘেঁষে। তার নরম বুক আমার কাঁধ স্পর্শ করে আছে। আমার গা শিরশির করে উঠলো। আমি বৌদির মুখের দিকে তাকালাম। তিনি মিটিমিটি হাসছেন। তার সারা শরীরে লাল শাড়ী ঝলমল করছে। তিনি খুব যত্ন করে সেজে গুঁজে এসেছেন। আমি তার হঠাৎ এরকম সাজার কারণ অনুসন্ধান করতে পারলাম না। বৌদির ফর্সা মেদহীন শরীরের অদ্ভুত মাদকতাপূর্ণ সুগন্ধ আমার নাকে এসে পড়ছে। ভীষণ ভাল লাগছে আমার। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে বৌদির। শরীরের কোথাও সামান্যতম কমতি নেই। একনজরে কেউ দেখে বলতে সাহস করবে না এই মেয়ে বিবাহিতা। 

বৌদি আমার পেছন থেকে সরলেন না। একমনে আমার কাঁধে শরীর লাগিয়ে টিভি দেখতে লাগলেন। আমার খুব অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো। কিন্তু কাঁধ সরিয়ে নেয়ারও কোন সুযোগ ছিলো না। তাহলে যে প্রথমে বৌদিকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে। অথবা বলতে হবে, বৌদি তুমি একটু পেছন দিকে সরে দাঁড়াও তো’। সত্যি কথা বলতে কী, এ কাজটা করার সাহসও আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছিল না তখন। 
আমি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, এতো সুন্দর করে সেজেছো কেন বৌদি, দাদার সাথে বেড়াতে যাবে?
আমি সামনে থাকায় বৌদির মুখের অবস্থার পরিবর্তন হলো কী না দেখা হলো না। বৌদি নিচু গলায় বললেন, তোমার দাদা তো নেই। তিন দিনের জন্য চিটাগং গেেেছন। 
‘তোমাদের কাজের ছেলেটা?’
‘ও কাল দেশে গেছে। ওর মা’র অসুখ।’
‘তুমি কী আমাকে বাসায় রেখে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছো?’
‘না তেমন কিছু না।’
‘তবে সেজেছো কেন? এমনিতে কেউ সাজে?’
‘আজ সাজলাম। ইচ্ছে হলো তাই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, এমনিতে তো ডাকো না। আজ হঠাৎ ডেকে পাঠালে কেন? কোন সমস্যা?’
‘না-না সমস্যা কী। বাসায় কেউ নেই। তুমি তো জানো একলা থাকতে আমার ভয় করে। তাই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। রাতে আমার সাথে থাকবে। কী আপত্তি আছে?’
আমি হেসে ফেললাম, বারে, তোমার সাথে থাকবো তাতে আপত্তির কী? তবে বৌদি, আমার স্বভাব সম্পর্কে তো বললেই। রাতে এদিক-ওদিক হলে কিন্তু পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না হ্যাঁ, এই বলে রাখছি। 
বৌদি আমার সামনে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, তুমি যা পাজি হয়েছো না আজাকাল! তোমাকে নিয়ে মাইরি ভীষণ চিন্তা হয় আমার। 
‘শুনে খুব ভালো লাগলো বৌদি। অন্তত কেউ একজন আমার জন্য চিন্তা করে। 

বৌদি আমার আপন কেউ না। তথাপি তার সাথে আমার সম্পর্কটা খুব মধুর। সব কথাই তাকে অকোপটে বলে ফেলা যায়। তিনিও আমাকে বলেন তার অতীতের গল্প। অসীমদার স্ত্রী বলে আমি তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাও করে থাকি। সমবয়সি বলে কিংবা তার সাথে মধুর সম্পর্ক বলে যতোই গল্প গুজব, হাসাহাসি করি না কেন তার প্রতি আমার অন্তরে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ সব সময়ই কাজ করে। এটা অবশ্য বৌদিরও জানা। সব সময় ভাবি তিনি আমার দাদার স্ত্রী। পাতানো সম্পর্ক হলেও তিনি আমার বৌদি। এ বৃত্তের বাইরে যাবার প্রচেষ্টা কখনই আমার ছিলো না। কল্পনাও করতাম না। 

রাতে খেয়ে দেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখলাম আমরা। বৌদির সাথে এটা সেটা নিয়ে গল্প করলাম। হাসাহাসি করলাম। গল্পের ঝাঁপি শেষ হলো রাত বারোটার দিকে। তখন আমার ঘন ঘন হাই উঠতে শুরু করেছে। বৌদি বললেন, তোমার কী ঘুম পেয়েছে? 
আমার শরীরে তখন সারাদিনের ক্লান্তি। চোখ দুটো ঝিমিয়ে আসছিলো। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, হ্যাঁ, আমি এখন ঘুমোবো। 
‘তাহলে তুমি বরং আমার খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি একটু পরে আসছি। আমি নিচে ঘুমোবো। দরজা খোলাই থাক।’

সারাদিনের ধকল আর অধিক রাত জেগে টিভি দেখার ক্লান্তি এ দুয়ে মিলে চোখ দুটো জ্বালা করছিল এমনিতেই। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে রাজ্যের ঘুম যেন ঠেসে ধরলো আমাকে। আমি অতল ঘুমে তলিয়ে গেলাম মুহূর্তেই। মাঝরাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। সারা ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনুভব করলাম কেমন এক অশুর শক্তি যেন দু’হাত দিয়ে খুব জোরে জাপটে ধরে আছে আমাকে। এতো প্রকট জোরে যে কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে তা আগে জানা ছিল না আমার। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। লক্ষ্য করলাম আমি চিৎকারও করতে পারছি না। একটা নরম ঠোঁট যেন সেঁটে বসেছে আমার মুখের মধ্যে। আমি নিঃশ্বাসের সঙ্গে উদোম নারী দেহের গন্ধ পাচ্ছি। পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি। মুহূর্তেই বুঝে ফেললাম বৌদির কর্মকান্ড এটা। বৌদিই সেঁটে আছেন এভাবে আমার শরীরের সাথে। অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত এরকম কর্মকান্ড মোকাবেলার কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না আমার। পরিস্থিতি বুঝতেও পারছিলাম না ঠিক মতো। সঙ্গত কারণেই কিংকর্বত্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। খুব অসহায় লাগছিল নিজেকে। কয়েকবার জোর খাটালাম বৌদির কবল থেকে নিজের শরীরটা ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু আমার শুকনো শরীর অশুরের সাথে যুদ্ধ করে জিতবে কেমন করে? অবশেষে নিজের পরাজয়টা মেনে নিতে হলো। আমার পরাজয় অন্যরকম মাত্রা পেল বৌদির কাছে। তিনি আমাকে নিয়ে অন্য রকম যুদ্ধে মেতে উঠলেন। 

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গল আমার। তখন ঘন কুয়াশার চাদর ঢেকে ফেলেছে বাইরের পৃথিবীকে। জানালার কাঁচ গলে ঘরে ঢুকে পড়েছে  ভোরের চাপা আলো। আমি শরীর উঠাতে গিয়ে বাধাগ্রস্থ হলাম। দেখলাম বৌদির উদোম শরীর লেপ্টে আছে আমার শরীরের সাথে। গভীর ঘুমে নিমগ্ন তিনি। লজ্জায় চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো আমার। সকালে বৌদির সাথে চোখাচোখি হলে কী রকম বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে ভেবে গরম হয়ে এলো আমার কান জোড়া। অগত্যা আগে বৌদির ঘুম ভাঙ্গার প্রত্যাশায় ঘুমের ভান করে চোখ বুঁজে থাকতে হলো আমাকে।
 
দ্বিতীয়বার কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। যখন ঘুম ভাঙ্গল ততোক্ষণ এগারোটা বেজে গেছে। কানের কাছে টেবিল ঘড়ির এলার্মের একটানা বিরক্তিকর শব্দে জেগে উঠলাম হুড়মুড়িয়ে। চোখ খুলে দেখি বৌদি আমার কানের কাছে টেবিল ঘড়ি ধরে আছেন। তার সমস্ত চোখ  মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। খুশিতে মুখমন্ডল ঝলমল করছে। এই কিছুক্ষণ আগে গোসল সেরে এসেছেন তিনি। ভেজা চুলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেজা চুলের সুগন্ধ আমার নাকে আসছে। আমার ভাল লাগছে। 
রাতের ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে খাটে বসলাম। বৌদির ঝলমলে আনন্দময় সুন্দর মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না দ্বিতীয়বার। একটা ভয়ংকর অপরাধবোধ সে মুহূর্তে গ্রাস করে ফেললো আমাকে। লজ্জায় মাথাটা নূয়ে এলো আপনা থেকেই। নিজের ওপর ঘৃণা হতে লাগলো। এ আমি কী করলাম? এ পাপের ক্ষমা আমি কার কাছে চাইবো? 

বৌদি নিঃশব্দে আমার পাশ ঘেঁষে বসলেন। পরম আদরে দু’হাত  দিয়ে আমার মুখটা তার মুখের কাছে তুলে ধরলেন। সমস্ত লজ্জা আর ঘৃণা পায়ে দলে ধীরে ধীরে চোখ খুললাম আমি। বৌদির মুখের দিকে তাকালাম। খুবই আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম, বৌদির কাঁচের মতো স্বচ্ছ সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বৌদি কাঁদছেন। নীরবে কাঁদছেন। অথচ এই মিনিট দুই আগেও বৌদির সারামুখ জুড়ে আনন্দ ঝলমল করছিল। 
বৌদির চোখে নিষ্পাপ কান্না দেখে আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। বুকের গহীনে জমে থাকা অপরাধবোধ আবার মারাত্মকভাবে নাড়া দিলো আমাকে। আমি খপ করে বৌদির হাত ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও বৌদি। আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি। সেই সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। জানি এ কঠিন পাপের কোন ক্ষমা নেই। 
বৌদি তার চোখের পানি মুছে ফেললেন। অনুরূপ ভাবে আমার হাত দুটো ধরে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, বরং তুমিই আমাকে ক্ষমা করে দাও সাজ্জাদ। আজকের রাতের ঘটনার জন্য আমিই দায়ি। আমিই ইচ্ছে করে এসব করেছি। তোমাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে এসেছি। কাজের ছেলেকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়েছি। 
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বলো কী!
বৌদি মুখ বুঁজে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর চোখ মুছে স্বাভাবিক হলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ। আসলে একটা সন্তান চাই আমার। 
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, সন্তান?
বৌদি মুখ নিচু করে বললেন, হ্যাঁ সন্তান। তুমি তো জানো তোমার দাদাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছি। তাঁকে আমি কী পরিমান ভালোবাসি জানো না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আর সব সামর্থ থাকলেও এই একটি মাত্র সামর্থ তাঁর নেই। এর জন্য আমাদের দাম্পত্য জীবনটা অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। ডাক্তার বলেছেন, তোমার দাদা আমাকে কোন দিনই সন্তান দিতে পারবেন না। এটা কেবল আমি জানি। তোমার দাদা শুনলে কষ্ট পাবেন বলে তাঁকে জানানো হয়নি। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে আমাদের। কোন সন্তান হয়নি। একটা সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তোমার দাদা। সন্তানের জন্য তিনি সারাক্ষণ আমাকে দুষছেন। বলছেন প্রয়োজন হলে তিনি আমাকে ত্যাগ করবেন। আরও একটা বিয়ে করবেন। এদিক-সেদিক পাত্রীও নাকি খুঁজছেন। এটা মেনে নেওয়া যায় বলো? কোন বিবাহিতা স্ত্রী তার স্বামীর ভাগ কী অন্য কাউকে দিতে পারে? তাছাড়া আমি তো জানি, তোমার দাদাকে হারালে আমিও বাঁচবো না। তাই সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত এ অন্যায় কাজটা আমাকে করতেই হলো। এখন তুমিই বলো নিজেকে বাঁচানোর জন্য মানুষ পৃথিবীতে কতো বড় বড় অপরাধই তো করছে। দুটো প্রাণকে বাঁচানোর জন্য এ সামান্য অন্যায় কাজটা না হয় আমিও করলাম। আমিও তো মানুষ। আমার বাঁচার চেষ্টা থাকবে না?   
আমি বৌদির কথার কোন উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, কিন্তু দাদা যদি প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন? 
‘জানবে না। তুমি কাউকে না বললে কাক পক্ষীও জানবে না।’
আমি বৌদির মুখের দিকে হ্যাবলার মতো হা করে তাকিয়ে থাকলাম। 

আসার সময় বৌদি আমার হাত ধরে বললেন, তোমার এ বৃহৎ ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারবো না। আজ তুমি আমাকে নতুন করে জীবন দিলে। আমার নারী জীবন পূর্ণতা পেল। দুটি নিষ্পাপ জীবনকে বাঁচাতে আমরা যদি ছোট্ট একটি পাপ করেই থাকি তাহলে মহান সৃষ্টিকর্তা সে পাপ থেকে অবশ্যই আমাদের মুক্তি দেবেন। 
বৌদি আমার হাতে একতোড়া টাকা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার জীবনকে বাঁচাতে ঢাকা ছেড়ে দেশে যাচ্ছো। তোমার মতো মহৎপ্রাণ মানুষ এ জীবনে আর দেখিনি। এই সামান্য টাকাগুলো নিয়ে যাও। জীবনে কিছুটা কাজে লাগবে। এটা প্রতিদান নয়। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। মনে করো, জীবনে খুবই বাজে ধরনের একজন বৌদির সাথে পরিচয় হয়েছিলো তোমার। সেই বৌদি নিজের জীবনের প্রয়োজনে সব কিছুই করতে পারে। তুমি সেই বৌদিকে মনে মনে অভিশাপ দিও। 
কথাগুলো বলে বৌদি মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি রুমাল দিয়ে বৌদির চোখ থেকে অশ্রু মুছে দিলাম। বিদায় বেলা সহসা আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। তীব্র  এক কষ্টে বুকটা দুমড়ে মুষড়ে যাচ্ছিলো। শেষে বৌদি বললেন, তোমার অবদানের কথা আমার আজীবন মানে থাকবে। আর আমাদের দেখা হবে কী না জানি না! দেশে গিয়ে ভালো থেকো। সুখে থেকো। 

সেদিনই গাড়ি ধরে ঢাকা থেকে বগুড়ায় এলাম আমি । কিছুদিন পর একটা এনজিওতে বড় পদে চাকরি নিলাম। আজ প্রায় এক যুগ পার হলো। এর ফাঁকে বিয়েও করেছি পাঁচ বছর আগে। আমার ঘরে সুন্দরী স্ত্রী। তার কোলে ফুটফুটে একটা মেয়ে। ভীষণ সুখী আমি এখন। অথচ কী আশ্চর্য, এই দীর্ঘ বারো বছরে একবারও ঢাকামুখো হইনি আর। অফিস থেকে কতো তাড়া এসেছে। বিভিন্ন ছুঁতো করে এটা সেটা বলে কোনমতে কাটিয়ে দিয়েছি। 
মাঝে মধ্যে বৌদিকে খুব মনে পড়েছে। মনে হয়েছে কোন একটা ছুঁতো করেই হোক আমার সেই প্রিয় বৌদিকে একটু খানি দেখে আসি একবার। কিন্তু অর্ফিসের কাজের চাপ অথবা অন্য কোন ব্যস্ততায় শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। শুনেছি বৌদির নাকি একটা ছেলে হয়েছে। আমার মতো নাকি দেখতে হয়েছে অনেকটা। আমার নামের সাথে মিলিয়ে বৌদি তার নামও রেখেছেন, সাজু। সাজু এখন অনেক বড় হয়েছে শুনেছি। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে। দাদা নাকি সাজুকে খুব আদর করেন। 

সংসার, চাকরি, কাজের চাপ এসবে বৌদিকে অনেকদিন মোটামুটি ভুলেই ছিলাম আমি। গতকাল অফিসে এসে হুট করে একটা চিঠি পেলাম বৌদির। বৌদির সহস্তে লিখিত চিঠি। বৌদি লিখেছেন-

সাজ্জাদ,
আমার আশীর্বাদ নিও। আশা করি, স্ত্রী সন্তান সহ ভগবানের দয়ায় সুস্বাস্থ্যেই আছো। এই দীর্ঘ সময়ে তুমি আমার কোন খোঁজ খবর নাও নি। কিন্তু তোমার সব খবর আমার জানা। 
ক’দিন ধরে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। গত সপ্তাহে একবার স্ট্রোক করেছিলো আমার। একটা বাইপাস অপারেশন করাতে হবে। সবাই বলছেন আমার বাঁচার আশা নাকি খুবই ক্ষীণ। আর হয়তো সময় পাবে না। পারলে শেষবারের মতো একবার এসে তোমার বৌদিকে দেখে যাও। তোমার সন্তানকে দেখে যাও। 
ইতি,
তোমার বৌদি

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।