নির্বাক সকাল ।। আব্দুল খালেক ফারুক
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫
প্রকাশক : চমন প্রকাশ ।। মূল্য : ২০০ টাকা
“নির্বাক সকাল” যাপিত সময়ের এগারোটি গল্পের এক অসাধারণ সংকলন। রাষ্ট্র ও সমাজকে ছুঁয়ে যাওয়া মানুষের জীবন—তার সংগ্রাম, ভালোবাসা, প্রতারণা, অসহায়ত্ব ও টিকে থাকার লড়াই—এই গল্পগুলোর মূল উপজীব্য। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের বাস্তবতার পটভূমিতে রচিত প্রতিটি গল্প লেখকের গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুভবের ছাপ বহন করে। কোথাও তিনি থেমে ভাবছেন, কোথাও আবার হাঁটছেন জীবনের অনন্ত পথ ধরে।
এখানে যেমন আছে সহজ-সরল প্রতারিত মানুষের গল্প, তেমনি বৈরী সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া জীবনের আর্তনাদও। সমাজের অসংগতি রম্যরসের মোড়কে উঠে এসেছে, আবার কোথাও অন্তর্জালে ধরা দিয়েছে মায়াবী প্রেমের আভাস। প্রতিটি গল্প শব্দে শব্দে সময়কে ধারণ করেছে। এক সকালে কলেজ শিক্ষক রাহাত নবনির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারে, নবনি কথা বলতে পারে না। কবিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সম্পর্কের পেছনে থাকা এই নীরব সত্য পাঠককে বাস্তবতার কঠিন মুখোমুখি দাঁড় করায়—কখনও কখনও নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আধাপাকা ঘরের বারান্দায় হারান মণ্ডল ও শিয়ালুর জীবনের গল্প আমাদের মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজের আরেক বাস্তবতা তুলে ধরে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, রাজাকার মকবুলের স্মরণ এবং পরবর্তী সময়ে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া হারানের জীবন যেন এক ইতিহাসের দলিল।
আবুল হাশেমের গল্প আমাদের সামনে সমাজের আরেক নিষ্ঠুর চিত্র উন্মোচন করে। প্রতিদিন হাসিমুখে সবাইকে সালাম জানিয়ে চারপাশের মানুষকে সম্মান জানানো এক সিকিউরিটি গার্ডের জীবনে ঘটে যায় অকল্পনীয় এক ঘটনা—তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে শুধুমাত্র একজন নেতাকে সালাম না দেওয়ার ‘অপরাধে’ নির্মমভাবে মার খায়।
মতিনের নিরুদ্দেশ হাঁটা বা ফজর আলীর বুদ্ধির জোরে জেল থেকে বেরিয়ে আসার গল্পগুলো শহুরে জীবনের আরেক দিককে দেখায়।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার শোষণও গল্পে উঠে এসেছে। সুদমুক্ত ঋণের আশায় রাজধানীতে আসা জরিনার কাহিনি বা ক্ষুদ্র ঋণের তিক্ত অভিজ্ঞতা—সবই বলে দেয় রাজনীতি কীভাবে অসহায় মানুষকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিনের গল্পে দেশপ্রেম ও প্রজন্মের দূরত্ব একসঙ্গে ধরা দেয়। সার্টিফিকেটের জন্য নয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করা মানুষের নাতি যখন আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায় না। অভ্যুত্থানের পরে তার ছেলে গণভবন থেকে ফ্যান লুট করে নিয়ে এলেও বিবেকের দায়ে তিনি তাঁর নিজের ঘরে ফ্যান লাগাতে দিলেন না বরং তীব্র গরমকে তিনি বেছে নিলেন।
জীবনে যত সংগ্রাম, যুদ্ধ বা উচ্ছ্বাসই থাকুক, তবুও প্রেম একসময় জীবনে এসে যায়। কেউ কেউ যেমন সুজানার মতো সময়ের আগেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তেমনি রুহুলদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। টিউশনের টাকায় প্রেম টিকলেও সংসার টেকে না—তাই প্রেমের পর বিচ্ছেদ অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কখনও পরিবারের চাপ কিংবা উন্নত জীবনের আহ্বানে মুঞ্জুরিরা মাহমুদের হাত ছেড়ে চলে যায়। তবে সবাই যে ছেড়ে যায়, তা নয়। অনেক লুবনা ও শামিমরা প্রিয়জনের পাশে থেকে সাহস দেয়, শক্তি জোগায় এবং জীবনের লড়াইয়ে সঙ্গী হয়ে ওঠে।
উলিপুর চরের ছেলে বদরুল ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। শহরের দাপটের সঙ্গে লড়াই করতে করতে, যদি কেউ তাকে জ্যান্তে বা বিপদের দিকে ঠেলে দেয়, সে কেতেকাটি ঘুষি দিতে পারে। তার রিকশার তলায় দুইটি লাঠি রাখা থাকে, কিন্তু তবুও নদীর শক্তির সঙ্গে সে কোনোভাবেই লড়তে পারেনি। নদী ভাঙনের কারণে বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসে বসবাস করতে হয়েছে।
বদরুল এত সংগ্রামের মধ্যেও একজন সরল মানুষ। তাই কেউ তাকে মফিজ বলে অপমান করলে, তা মেনে নিতে পারে না। একদিন এক ছাত্র তার রিকশা ভাড়া করে, কিন্তু ভাড়ার টাকা না দিয়ে চলে যায়।
বদরুলের ক্ষোভ ঝরে পড়ে—“এই শালা ছাত্র থাকতে এই অবস্থা, চাকরি করলে ও দেশ ব্যাচে খাইবে।”



চমৎকার
ReplyDelete