প্রিয় থেকে প্রেয়সী ।। মো. সাজ্জাদ হোসেন



সেদিন চৈত্র মাস তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। কোন একদিন চৈত্রের তপ্ত দুপুরে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। চৈত্র মাসের তপ্ত দুপুর, গ্রীষ্মের তাপদাহ স্মৃতিময় একটি দিন। প্রথম দর্শন মনে কোন দৌলা দেয়নি। হৃদয়ে তোলেনি কোন ঝংকার। প্রেমিক মন ছিল অচেতন। কাজের প্রয়োজনে পরিচয়। একটু কথাবার্তা,ভাবের আদান প্রদান। ডিজিটাল যুগ ফোন নাম্বারের আদান প্রদান। ভদ্রতার খাতিরে নাম্বারটি মোবাইল ফোনে সেভ করেছিলাম। প্রথম দর্শনে ভালোলাগা বা ভালবাসা কোনটিই হয়নি। বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে সারাক্ষণ যে এলোমেলা ভাবে উদ্দেশ্যহীন চলাফেরা করে তার কাছে ভালোলাগা এবং ভালবাসা অর্থহীন। বোহিমিয়ানের জীবন যার পছন্দ তার কাছে প্রেমে পরা বা কাউকে প্রেম নিবেদন করাটা অলীক ভাবনা। সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। সবাই সুন্দরের পূজারী। অসুন্দরকে কেউ পূজা করেনা। সবাই সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই। তবে কতজন সৌন্দর্যকে সম্মান করতে পারে? বোহিমিয়ানরা কাউকে অশ্রদ্ধা করতে জানেনা। বোহিমিয়ানরা জানে কেউ আজীবন বোহিমিয়ানের জীবন নিয়ে চলতে পারেনা। নিয়মের বেড়াজালে একদিন বন্দি হতেই হবে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই পৃথিবীতে আসা আবার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। নিয়মের বাইরে কেউ নয়। সবাই সময়ের ফ্রেমে বন্দী।
চৈত্রের তপ্ত দুপুরে যার সাথে পরিচয় তার সাথে এখন নিয়মিত দেখা হয়,কথাও হয়। ভদ্রতার সমস্ত কিছুই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে লক্ষণীয়। মানুষকে সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করতে পারে আবার ভদ্রতাও মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে। নিজে অভদ্র হলেও মানুষের কাছে ভদ্র আচরণ সবাই প্রত্যাশা করে। ভদ্রতায় বংশের পরিচয়। সততা ও ভদ্রতার চেয়ে বড় সম্পদ আর কি হতে পারে। সততা ও ভদ্রতা যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এটাই তার বড় সৌন্দর্য। ভদ্রতা দিয়ে যে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে তাকেইতো ভালবাসা যায়। ভালবাসতে হয়। সৃষ্টিলগ্ন থেকে যেহেতু  মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী তাই সৌন্দর্য ছাড়া শুধুমাত্র ভদ্রতাই মানুষকে মুগ্ধ করবে এটা শতভাগ সত্য হতে পারেনা। কেউ কেউ পছন্দ করে গায়ের রং। মানুষ ভেদে পছন্দ আলাদা হতে পারে। যেমন ফর্সা,শ্যামলা,চোখ,মুখ,নাক,চুল ঠোঁট আরও কত কি। তবে কালো মানুষকে সবাই পছন্দ করেনা। কালো মানুষকে সবাই পছন্দ করলে পৃথিবীতে বর্ণবাদ প্রথা থাকত না। আর বর্ণবাদের জন্য লক্ষ লক্ষ কালো মানুষকে জীবন দিতে হতনা। তবে শ্যামলা রংয়ের কাজল কালো চোখের মেয়েটির প্রতি সত্যিই মায়ায় পরেছিলাম। এই মায়া হৃদয়ে একটু ব্যথা দিত। তার কথা যখন মনে পড়ত অন্তরে ব্যথা অনুভব করতাম। তার মন জয় করার ফন্দী ফিকির কোনটাই আমার মাঝে কাজ  করতনা। তাকে পওয়ার কোন আকাঙ্খাও তৈরি হতনা। তার সাথে কথা বললে হৃদয় পুলকিত হতনা। কোন রোমাঞ্চ কাজ করতনা। কল্পনার রাজ্যে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটাও আমার মন সায় দেয়নি। ভাবনার জগতটাকে সংকুচিত করে রাখতাম। ভালো লাগলেও বুকে সাহস নিয়ে তাকে কিছু বলতেও পারব না। ডিজিটাল যুগে ভালবাসার কথা বলা খুব কঠিন কাজ নয়। ইন্টারনেটের যুগে ফেসবুক,মেসেঞ্জার,ইমো,ভাইবারে ভালবাসার কথা বলাটা খুব সহজ। খুব সহজে ভালবাসার কথা বলা যায়। অল্প দিনেই সম্পর্ক গভীর হয়। আবার  সেই সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতেও সময় লাগেনা। স্বপ্নহীন জীবনে কোন স্বপ্নও দেখতাম না। স্বপ্ন দেখতে প্রচন্ড ভয় পেতাম। জীবনে ছোট বড় অনেক ধাক্কা খেয়েছি,স্বপ্নের সাথে পেরে উঠতাম না। স্বপ্নের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছি। 
খুব অল্পদিনের মধ্যে তাকে নিয়ে আমার মনে নতুন ভাবনা কাজ করতে শুরু করেছিল। আমার ভাবনাটা তাকে বলতেও পারতাম না। নিজের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করত। খুব সংকোচ বোধ করতাম। নিজেকে ছোট মনে হত। নিজের সাথে নিজেই পেরে উঠতামনা। নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত ছিলনা।  কাদা মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সব সময় মনে হত যদি চোরাবালিতে ডুবে যায় তখন কি হবে। চোরাবালিতে আমি ডুব সাঁতার দিতে পারি। পৃথিবীতে দয়াবান কেউ থাকলে আমাকে টেনে তুলবে। দুজনকে একসাথে টেনে তুলবে এমন মানুষ নাও থাকতে পারে। সবার দৃষ্টি যদি অন্য দিকে থাকে তাহলে ডুবে মরে যেতে হবে। আমার প্রতি তার বিশেষ কোন দুর্বলতা ছিল এটাও তার কথায়,চালচলনে প্রকাশ পেতনা। আমাকে অবজ্ঞা করত এটাও মনে হতনা। সে নিজেও কিছুটা সংকোচবোধ করত এটা বুঝতে পেরেছিলাম। সংকোচবোধ থাকার পরেও আমার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত এটা শতভাগ সত্য। আমার মধ্যে কিছুটা আবেগ উতলে উঠেছিল। আবেগ আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। আবেগের বিষক্রিয়ায় আমি জর্জরিত। আবেগের বিষক্রিয়ার যন্ত্রণায় আমার জীবনে ছন্দ পতন ঘটতে শুরু করল। ভাবনা চিন্তা নতুন মোড় নিতে শুরু করল। দিনে রাতে নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা মাথায় আসতে শুরু করল। সব ভাবনা চিন্তাকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখে যেটা বুঝেছিলাম তা আমার জন্য অনেক ক্ষতিকর। এজন্য  আবেগের বাঁধকে ভেঙ্গে পরতে দিতাম না। সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলাম। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার জীবনে যখন সুদিন আসবে তখন নতুন করে চিন্তা ভাবনা করে দেখব। দুর্দিনের মেঘের ঘনঘটা  যে খুব সহজে কেটে যাবে তার কোন লক্ষণ দেখা দেখতে যায়না। সামনে যেটা দেখতে পেতাম তা হলো দুর্গমগিরি কান্তার মরু। দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দেওয়া সহজ ছিলনা। সবকিছুতে অনিশ্চিত পথ চলা। অন্ধকার পথে চলতে শুরু করলাম। পথ চলতে চলতে দূর দিগন্তে কিছুটা আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম। বিজলীর মত এক ঝলক দেখা দিয়ে দূর আকাশে বিলীন হয়ে গেল। বিজলীর আলো আমাকে নতুন ভাবনায় ফেলে দিল। মনে মনে স্থির করলাম এই আলোর সন্ধান আমাকে করতেই হবে। এই আলো কোন মরীচিকা না। এটা মরীচিকা হতে পারেনা। এই আলোর সন্ধান আমাকে করতেই হবে। এক সময় সেই আলোর সন্ধান পেলাম। আলোর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেলাম। সেই আলো আমাকে কিছুটা আলোকিত করল। নতুন আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করলাম। নতুন আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে চেষ্টা করলাম। প্রতিদিন সূর্য উঠে,আবার সূর্য অস্ত যায়। সময় আমাদেরকে যে ফ্রেমে বন্দী করেছে সেই ফ্রেমের মধ্যেই আমাদের জীবন। আলো আলো হয়েই জীবনে আসে। আলো অন্ধকারের কাছে পরাজিত হয় ক্ষণিকের জন্য। ক্ষণিকের জন্য আলো আমাদেরকে অন্ধকারের কাছে রেখে যায়। 
অতীতের বন্দীশালা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি। অনেক কন্টকময় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শিকলের যে বেড়ি দুপায়ে পরেছিলাম তা থেকে অনেক আগেই মুক্তি পেয়েছি। দুপায়ে যে কাঁটা ফুটেছিল তা নিজেই তুলে ফেলেছি। হৃদয়ের ব্যাকুলতা,সুপ্ত বাসনা থেকে সুখী জীবনের প্রত্যাশায়  হৃদয়ের গভীর থেকে যাকে চেয়েছি আজ তাকেই জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কবিতাখানি বার বার মনে পরে। 
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। 
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
অনেকগুলো বছর একসাথে কাটানোর পরও কানের কাছে মুখ রেখে আজও বলতে পারলামনা ‘ভালোবাসি শুধু তোমাকে’।

(প্রিয় থেকে প্রেয়সী ।। মো. সাজ্জাদ হোসেন)

মো.সাজ্জাদ হোসেন
প্রভাষক, লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ
নবীনগর,ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।