মিতা ।। নুরজাহান পারভীন


             আমার নাম মিতা
             মাথায় পড়ি ফিতা
             কানে পড়ি দুল
             বাবলা গাছের ফুল.....

বলে খেলা‌ করছিল মিতা ও তার বান্ধবী। আজ সেই মিতা বৃদ্ধ হয়ে গেছে। তার জীবনে ঘটে গেছে হাজারো আশাতীত ঘটনা।চলুন জানা যাক মিতার ঘটনা। সময়টা ১৯৫৩ সাল পলাশপুর নামক একটি ছোট্ট গ্রামে বাবা মায়ের কোল উজ্জল করে আসে একটি মেয়ে শিশু। বাবা মা আদর করে তার নাম রাখে মিতা খাতুন।মিতা ছিল খুব চঞ্চল মেয়ে।‌সবসময় তার বান্ধবীদের সঙ্গে মিলে দুষ্টামি করে বেড়াত। কখনও কারও পানির মটকা ভাঙত কখনও বা কারও ক্ষেতের জিনিস চুরি করে ছোট খাটো ভোজনের আয়জন করত। এরপরও গ্রামবাসীরা তাকে খুব ভালোবাসত। কারণ সে ছিল লক্ষী মেয়ে বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করার ক্ষেত্রে তার কোন সময় কোন কমতি ছিল না। সে যে শুধু লক্ষীই ছিল তা নয় অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারিনীও ছিল।তাই তো তাকে যে একবার দেখত তার রুপের মোহে আটকা পড়ে যেত। তার এই অপূর্ব সুন্দর রূপের জন্য খুব অল্প বয়স থেকেই তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে।কিন্তু মিতার বাবা মা তাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না।এবং মিতারও ইচ্ছা ছিল না বিয়ে করার তার ইচ্ছা ছিল তার পরিবারের হাল ধরা। কারণ সে খুব করেই জানত তার বাবা কত কষ্ট করে তাদের সংসার চালায় যদিওবা তার বাবা তাকে কখনও তার কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলেনি। মিতার যখন ১৬ বছর‌ তখনই হঠাৎ করে তার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন এতই অসুস্থ হয়ে পড়েলেন সেখান সেরে ওঠা তার জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠল। আর মিতার পরিবারের এত সামর্থও ছিল না যে তারা মিতার বাবার চিকিৎসা করাবে। তাই মিতার‌ বাবা শেষ ইচ্ছা হিসেবে তার আদরের মেয়ে মিতার বিয়ে স্বচক্ষে দেখতে চাইলেন। মিতা তার বাবাকে খুব ভালোবাসত তাই সে তার বাবার শেষ ইচ্ছা রক্ষার্থে নিজের‌ ইচ্ছার বলিদান দিল।সেই সময় মিতাকে বিয়ে করার জন্য কেও আর এগোতে চাইল না কারণ সে পূর্বেই অনেক প্রস্তাব প্রত্যাখান করছিল।আর সেই সময় প্রস্তাবের প্রত্যাখান অনেক বড় সম্মান হানির  ব্যাপার ছিল। তবুও পাত্রের অনুসন্ধান চলতে থাকে, অনেক খোজাখুজির পর ঘটক একটি পাত্রের প্রস্তাব আনে যার নাম ছিল রহমত আলী। রহমত আলীর ছিল করিম আলী জমিদারের একমাত্র পুত্র এবং অনেক জমাজমির মালিক। রহমত আলীর পূর্বেও একটি স্ত্রী ছিল যার কোন সন্তান ছিল না। যার কারণে  রহমত আলী তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। তাই একটা সময় রহমত আলীর পূর্বের স্ত্রী সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এইসব বিষয়ে খুব ভালোভাবে অবগত হওয়া সত্ত্বেও ঘটক মিতার জন্য রহমত আলীর প্রস্তাব আনে। কারণ মিতার মা ঘটককে কাতর স্বরে অনুরোধ করেছিল‌ মিতার বাবার মৃত্যুর পূর্বেই যেন মিতার বিয়ে হয়ে যায় তাই কোন উপায় না পেয়ে ঘটক মিতার জন্য রহমত আলীর প্রস্তাব আনে এবং মিতার পরিবারের কাছে রহমত আলীর ঘটনা গোপন রাখে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মিতার বিয়ে হয়ে যায়। রহমত আলী যৌতুক হিসেবে মিতার পরিবারের শেষ সম্বল মিতার বাবার জমিটুকু কেড়ে নেয়।‌ এতকিছুর পরও রহমত আলী যেন সন্তুষ্ট থাকে নাই । বিয়ের পর যৌতুকের নামে মিতার উপরও অমানুষিক নির্যাতন চালান। কিন্তু এবার রহমত আলী পার পায় না বিয়ের দুই তিন বছরের মাথায় হার্ট এর্টাকে‌ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রহমত আলীর মৃত্যুর পর মিতা আর বিয়ে করেন না।সারাজীবন একলা সংসার চালিয়ে যান। মিতা এবং রহমত আলীর একটি সন্তান হয়েছিল যার নাম রহমত আলী রেখেছিলেন রোহান আলী। রহমত আলীর মৃত্যুর পর মিতার জীবন হয়ে যায় নিঃস্ব কিন্তু মিতা বসে থাকে নি তার নিজের হাতে সংসারের হাল ধরেছেন। মিতা বেগমের সন্তান রোহান ছিল অত্যন্ত বিলাসীতা পূর্ণ স্বভাবের যদিওবা তাদের সংসারের অবস্থা সচ্ছল ছিল না।  রোহান সবসময় দামি দামি জিনিসের আবদার করত এবং মিতা বেগম রোহানের প্রতি তার অতিরিক্ত মায়ার জন্য তা না করতে পারতেন না কোন না কোনভাবে সেই জিনিসটি রোহানের সামনে হাজির করতেন। সময় বাড়তে থাকে রোহানও সময়ের সাথে সাথে বড় হতে থাকে । অল্প কিছু বছর আগের কথা রোহানের একটি চাকরির ইন্টারভিউ ছিল সেই দিন মিতা বেগম প্রাণভরে দোয়া করছিলেন তার ছেলের চাকরিটি যেন হয়ে যায়। তার দোয়া কাজে লাগে রোহানের চাকরিটি হয়ে যায়। চাকরির অল্পকিছু দিনের‌ মধ্যে রোহানের প্রীতি নামক একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।মিতা কোন আপত্তি ছাড়াই হাসিমুখে তাদেরকে মেনে নেয়। দিন মোটামুটি ভালোই কাটছিল ।খুব শ্রীগ্রই প্রীতির কোলে একটি ফুটফুটে মেয়ে শিশু জন্ম নেয়।প্রীতি তার নাম দেয় প্রিয়া রায়। মিতা বেগম তাতে সামান্য আপত্তি জানিয়ে বলেন তার শিশুটির নাম রোহানের নামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে রাখতে। কিন্তু প্রীতি তা করতে অস্বীকার করে এবং মিতা বেগমকে খারাপ নজরে দেখতে শুরু করে। দিন আরও বাড়তে থাকে । কিছু দিনের মধ্যেই প্রীতির কোলে আসে আরেকটি শিশু ।যার নামকরণের দিন মিতা বেগম তার নাম রাখতে চাইলে প্রীতি রেগে বলে দেয়, "আপনার এত তদারকি করার দরকার নেই।আমার সন্তানের নাম আমি রাখব,সেটা একান্তই আমার।" মিতা বেগম চুপ হয়ে রইলেন প্রীতিকে কিছু বললেন না। সেখানে রোহানসহ আরও অনেকে উপস্থিত থাকায় মিতা বেগম খুব অবাক আর একটু কষ্টও পেলেন। মিতা বেগম ভাবতেও পারেননি প্রীতি সবার সামনে তাকে এভাবে বলবে।কিন্তু তবুও মিতা বেগম প্রীতিকে ক্ষমা করে দেয় এই ভেবে যে, প্রীতি ছোট মানুষ সে কথা বলার হুশ পায় না, সে ধীরে ধীরে সুধরে যাবে।কিন্তু আর সে সুধরায় না দিনে দিনে তার  ব্যবহার আরও খারাপ হতে থাকে। একদিনতো সে রোহানকে বলেই ফেলে মিতা বেগমকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে।প্রথম প্রথম রোহান আপত্তি জানালেও পরবর্তীতে সে প্রীতির জালে ফেসে যায় এবং রেখে আসে মিতা বেগমকে বৃদ্ধাশ্রমে।বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার পর মিতা বেগম বুঝতে পারলেন কেউ আসলে ছোট না সবাই নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে তাইতো পরিবার থেকে তাকে বেড় করে দেওয়া হয়েছে। দিন আবারও যেতে শুরু করে এবং দিনের সাথে সাথে বৃদ্ধাশ্রমে নিজেকে মানিয়ে নেয় মিতা বেগম। একদিন বৃদ্ধাশ্রমে ঘটে আজব ঘটনা রোহান এসেছে মিতা বেগমকে নিয়ে যেতে। এত কষ্ট দেওয়ার পরও ছেলের মুখ দেখে মিতা বেগম যেন সব কষ্ট ভুলে যায়। বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি মিতা বেগমের পা ধরে কান্না করে ক্ষমা চায়। মূলত এটা ছিল প্রীতির আরেকটি নাটক । সে এই নাটক করছিল মূলত সম্পত্তির লোভে যা রহমত আলী মৃত্যুর পূর্বে মিতা বেগমের নামে করে গিয়েছিল। কিন্তু মিতা বেগম সেই সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। রোহান ওপ্রীতি বিশেষ করে প্রীতি চাচ্ছিল মিতা বেগম যেন তাদের নামে সব সম্পত্তি লিখে দেয়। সেই কারণে মিতা বেগমের সামনে ভালো হয়ে থাকার নাটক করচ্ছিল। প্রীতি আলতো আলতো করে মিতা বেগমের সামনে সম্পত্তির কথা তুলে ধরতে শুরু করে।কিন্তু যখনেই প্রীতি মিতা বেগমকে সম্পত্তির কথা বলত তখনেই মিতা বেগম তা সম্পর্কে না জানার কথা বলতেন কারণ তিনি আসলেই তা জানতেন না।একদিন রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিল সেই সময় তিনি তার দুই নাতি-নাতনি প্রিয়া ও প্রেমের সাথে খেলছিলেন। প্রিয়ার বয়স তখন ৭ এবং প্রেমের বয়স তখন ৫ বছর। খেলতে খেলতে তিনি প্রীতি ও রোহানের রুমের সামনে আসলেন । সেখানে তিনি শুনতে পারলেন প্রীতি রোহানকে বলছে,"আর কত দিন ! আর কত দিন তোমার ওই বুড়ি মায়ের অত্যাচার সহ্য করব,যখনেই তাকে সম্পত্তির কথা বলি এমন ভান করে যেন কিছুই জানে না।"তার উত্তরে রোহান বলল,"হয়তবা তিনি সত্যিই জানেন না সম্পত্তির ব্যাপারে।" "চুপ করো।সবসময় ওই বুড়ির পক্ষে থাকো,কোনদিনতো দেখলাম না আমার পক্ষে কথা বলছো।ভালো করে শুনে নেও যদি তুমি যদি আজকে ওই বুড়ির কাছ থেকে সাইন না আনতে পারো তবে আমার মরা মুখ দেখবে।" প্রীতি বলল ।শুধুএইটুকু শোনার বাকি ছিল মিতা বেগমের, মিতা বেগম সঙ্গে সঙ্গে তাদের রুমে প্রবেশ করলেন।এবং বলতে লাগলেন , "তোমরা কোন সম্পত্তির কথা বলছ,আমার যা যটুকু ছিল সবইতো তোমাদেরকে দিয়ে দিয়েছি।"এহে্ নেকা কত। সবই যদি দিয়েই থাক তাহলে এইটা কোথা থেকে উদ্ধার হলো হে্। ওত কিছু বুঝি না তাড়াতাড়ি সাইন কর আর এখান থেকে চলে তোমাকে আর সহ্য হয় না।" প্রীতি বলল। মিতা বেগম আর তর্কে জড়ালেন না চুপচাপ সাইন করে বৃষ্টির মধ্যে বেড়িয়ে পড়লেন। তাকে দেখে প্রিয়া আর প্রেম কাঁদতে লাগতে লাগল আর চিৎকার করে বলতে লাগলো যেও না দাদি ,যেও না।কিন্তু প্রীতির তাদের মুখ চেপে ঘরে ঠেলে দেয়। আপন দুঃখে বৃষ্টির মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে মিতা বেগম হার্ট এর্টাক করে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।আজ সেই ঘটনার ২০-২১ বছর হয়ে গেছে। প্রেম আর প্রিয়াও বিয়ে করে তাদের নতুন সংসার সাজিয়েছে। তোমরা কি জানো,রোহান ওপ্রীতির কি পরিণতি হলো। প্রেমের স্ত্রী নেহা তাদের পরিবারে প্রবেশের কিছু দিনের মধ্যে রোহান ওপ্রীতিকে ঘর থেকে বেড় করে দিল এবং প্রেমও তাতে কোন বাধা প্রদান করল না কারণ সে তার দাদির সাথে ঘটা মর্মান্তিক ঘটনা আজও ভুলতে পারে নাই। সব কথার শেষ কথা আপনি যেই পাপটি করবেন সেটা আপনার কাছেই ফিরে আসবে।আর এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘন্যতম পাপের একটি হচ্ছে বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া , হোক তা নিজের বাবা-মা বা শশুর-শাশুরি।


নুরজাহান পারভীন

কুড়িগ্রাম সদর, কুড়িগ্রাম।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।