টোকাইর স্বপ্ন ।। জোনাকী দত্ত

.  

মা, মাগো, আর একটু অপেক্ষা কর, আমি তোমার জন্য ঈদের নতুন শাড়ি, বোনের জন্য নতুন জামা নিয়ে বাড়ি ফিরব। ঈদের দিন তোমার হাতে সেমাই খাব।

 আমি আসছি মা,আসছি। এসব বলতে বলতে আবুল ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করতে লাগলো। পাশে থাকা সেন্টু আর রহমান ঘুম থেকে উঠে বসলো। আবুলকে গায়ে ধাক্কা দিয়ে সেন্টু বলল, এ্যাই আবুল, ঘুমের ঘোরে কি বলছিস? ওঠে বস। তুই কি স্বপ্ন দেখছিস? 

আবুল চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো। বলল, হ্যাঁ রে, মনে হয় স্বপ্ন দেখছিলাম। এবার বাড়ি থেকে আসার সময় ছোট বোনটা বলেছিল ঈদে নতুন জামা নিয়ে যেতে। আমি বোনকে বলেছিলাম ওর আর মায়ের জন্য নতুন পোশাক কিনে ঈদে বাড়ি ফিরবো। রহমান বলল, ও, তাই এই কদিন তুই রোজা রাখার নাম করে দিনের বেলা কিছু না খেয়ে টাকা জমিয়ে রাখিস। আর ইফতারের সময় সামান্য কিছু খেয়ে আবার কাজে লেগে পড়িস। সেন্টু বলল, এভাবে না খেয়ে পরিশ্রম করলে তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি।

 আবুল হেসে বলল, আমাদের কিছু হবে না রে। চল ঘুমিয়ে পড়। সকালে আবার কুলির কাজ, টোকাইর কাজ এগুলো তো করতে হবে। ওরা আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

আবুল একবছর হলো শহরে এসেছে। বাবা নেই। মা পরের ঘরে কাজ করে। ছোট বোন মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে আছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটে না ওদের। তাই একদিন আবুল শহরে চলে এলো। টাকা আয় করে মা বোনের দুঃখ দূর করার জন্য। এখানে এসে সেন্টু আর রহমান এর সাথে পরিচয়। ওরা একসাথে ফুটপাতে থাকে। টোকাইর কাজ করে। রেললাইনের যাত্রীদের মালপত্র বহন করে কুলির কাজ করে। যা আয় হয় তাতে ওদের পেট চলে যায়। কিন্তু সামনে ঈদ। তাই বাড়িতে মা বোনের জন্য নতুন পোশাক আর কিছু টাকা নিয়ে না গেলে তো হবে না। 

মাঝে একবার বাড়িতে গিয়ে আবুল মায়ের কাছে কিছু টাকা দিয়ে এসেছিল। তখন ছোট বোন বলেছিল, ভাইয়া, ঈদে কিন্তু আমার জন্য নতুন জামা আনতে হবে। মা আমাকে ফিতা আর চুড়ি কিনে দেবে বলেছে। মা ওকে ধমক দিয়ে বলল, আঃ, ওকে ভাতটুকু একটু শান্তিতে খেতে দে। কতো দিন পর আমি ছেলেকে কাছে বসিয়ে ভাত খেতে দিয়েছি। আবুল খেতে খেতে বলল, ওকে বকো না মা। ও তো ছোট। আমার কাছে আবদার করবে না তো কার কাছে করবে। তোমার হাতে ছোট মাছের তরকারি খুব মজা হয়েছে। অনেক দিন পর এমন তরকারি দিয়ে পেট ভরে খেলাম। মায়ের চোখে জল। মা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ওখানে ঠিকমতো খাস তো? তোর শরীর একেবারে শুকিয়ে গেছে। আবুল বলল, তুমি চিন্তা করো না মা। আমি ওখানে ঠিক আছি। তোমরা এখানে ভালো মতো খাবে। বোনকে আমি লেখাপড়া শিখিয়ে বড় মানুষ করবো। ওর কথা শুনে ছোট বোন খুশি হয়ে বলল, কি মজা, আমি স্কুলে যাব। আবুল বলল, আগে ঈদে এসে তোদের জন্য বাজার করে আমরা একসাথে ঈদ করব। মায়ের হাতে সেমাই খাব। এরপরে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেব।

এখন আবুল দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে ঈদে মা বোনের মুখে হাসি ফোটাতে। আদৌ কি আবুল তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে? এরকম কতো টোকাইর স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়। কতজনই বা রাখে তাদের খোঁজ।


পরিচয় -  শিক্ষিকা

চট্টগ্রাম।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।