রম্যগল্প
নরসুন্দরের মাথায় না কি শেয়ালের চেয়ে বুদ্ধি বেশি। বাংলা লোকসাহিত্যের গল্পগুলোতে নরসুন্দর বিচিত্র আঙ্গিকে চিত্রিত হয়েছে। এমন কি অনেক রাজা বাদশাহও নরসুন্দরের বুদ্ধির কাছে হার মেনেছে।
নরসুন্দরের সাথে শৈশব জড়িয়ে নেই এমন মানুষ খুব কমই আছে। শৈশব কৈশোর তারুণ্যের দিনগুলোতে অনেক রঙিলা নরসুন্দরের সাথে দেখা হয়েছে। তাদের কাছে মাথার চুল কেটেছি। এমনকি জাতক ঘর থেকে বেরিয়ে নবজাতকের ক্ষৌরি করাও দেখেছি। দেনা পাওনা নিয়ে নরসুন্দরদের বাতচিতও মনে রাখার মত।
আগের দিনে নাপিত,স্বর্ণকার এবং গোটকা মানে খৎনাকরনেওয়ালাদের ময়াল বা মহল ভাগ করা থাকত। কারো এলাকায় অন্য কেউ ঢুকতে পারত না।
আমাদের এলাকার অধিপতি ছিল ছবেদ আলি নরসুন্দর। ছোট খাটো চেহারা। মুখ খুললে ঝিঁঝি পোকার মত ক্যের ক্যের শব্দ হত। মর্দ আর শব্দে বিস্তর ব্যবধান ছিল।
তার বাড়িতে একটি ছনের ঘরে সে বসত।আধুনিক সেলুনের সেকেলে সংস্করণ যাকে বলে। সৌখিন লোকেরা তার বাড়িতে গিয়ে সেই সেলুনে টোলে বসে চুল কাটাতো। সপ্তাহে একদিন সে তার সেলুনে বসে ক্ষুর চালাত।
নরসুন্দর ছবেদ আলি সপ্তাহের বাকি ছ'দিন গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ক্ষৌরকর্ম করে বেড়াত। হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর কাঁচি, ক্ষুর,কাঠের ঢাকনা দেয়া রূপবানের ছবিযুক্ত আরশি আর একটা ভাঙা স্লেট। সেই স্লেটে মাঝে মাঝে ক্ষুর ধার দিত।
জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর বেলায় গেরস্থ বাড়ির দহলিজে বসতো। নিজে একখানা পিঁড়ির উপর বসত এবং সামনে আর একটা পিড়ি রাখতো।
আজকের মত তখনকার দিনের বাবারা এত হিসেবি বা অক্ষম ছিলেন না। তাদের গণ্ডা গণ্ডা পোলাপান থাকত। হয়তো জন্মশাসন প্রথা তখনও চালু হয় নি। তারা চারজন, পাঁচজন সর্বোচ্চ আট দশজন পোলাপান নিয়ে নাপিতের কাছে এসে বলতেন, এদের চামছাটা করে দাও।
চামছাট অনেকটা মাথামুণ্ডনের মত। নাপিতের সময় কম লাগে বলে চামছাটের খরচ আট পয়সা বা দুআনা।
ছেলে ছোকরারা চাইত দীলিপ ছাট বা উত্তম কুমারের মত ছাট। এ ধরনের ছাটে ছোটদের জন্য চৌদ্দ পয়সা বা সাড়ে তিন আনা আর বড়দের জন্য চার আনা।
অভিভাবক নাপিতের কাছে হাওলা করে দিয়ে চলে যেতেন। ছেলেছোকরারা ঘাঁইঘুই করত। কেননা,ওরা চামছাট পছন্দ করে না। ওরা চায় দীলিপকুমার বা উত্তম কুমারের মত ফ্যাশন করতে। তাই চাল বিক্রি করে আগেই ওরা গাঁটে পয়সা বেঁধে নিয়ে যেত। নরসুন্দরের সাথে গোপন চুক্তি করে পছন্দমত দীলিপ ছাট নিয়ে নিত।
ঘটনাটা বিষাক্ত হয়ে উঠত নাপিত যখন ক্ষুর চালাতো। বাটি থেকে পানি নিয়ে ঘষতো। আর এমন দানবীয় ঘষায় মনে হত চামড়া ছিড়ে যাচ্ছে। পোলাপানের কাছে অসহ্য হলেও রা কাড়তো না। তারপর যখন ক্ষুর চালাত তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। মনে হত এতো চুল কাটা নয় যেন ভুটিয়া সামারু মরা গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছে।
অনেক সময় নির্মম নরসুন্দরের বেদিশা ক্ষুর চালানোর ফলে দুর্ঘটনাও ঘটতো।
সে বার মিয়ারুদ্দি এসেছিল চুল কাটাতে। চুলে কাঁচির কাজ শেষ হওয়ার পর ক্ষুর লাগানোর জন্য পানি দিয়ে ঘষা শুরু করেছে ঠিক তখনই মেজাজি মিয়ারুদ্দিন লাফ দিয়ে
উঠে ক্রোধে বলতে লাগল, অমুকের ( অমুকের স্থলে এমন অশ্লীল এবং অশ্রাব্য শব্দ প্রয়োগ করেছিল যা ভদ্রলোকের শ্রুতি স্তব্ধ করার মত) পানি দিয়ে ঘষতে ঘষতে তো চামড়ার বারোটা বাজালে। ধুর শালা, অমুকের চুলই আর ছাটব না।
ছবেদ আলি মিয়ারুদ্দির এমন আচরণে প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে সহসাই নিজেকে সামলে নিল। তারপর বলল, অমন গুলি খাওয়া মইষের নাহাল খাড়ইয়া পড়লে কে রে?
খাড়ইমু না? শালা তুমি পানি দিয়া ঘইষা ঘইষা আমার চুল চামড়া সব তুইলা ফালছো। ইসঃ কেমন জ্বলা জ্বলতাছে। আর চুল কাটমু না। বাইত যাইয়ে বউকে কমু কমেট বেলেড দিয়ে চাইচ্চে দিব। শালার নাপিতের গোষ্ঠী কিলাই।
মিয়ারুদ্দির সাথে সবাই সংহতি প্রকাশ করে। আবেদালি মণ্ডল গণ্যমান্য লোক। সেও বলে, না গো ছবেদ, তুমি ঘষাঘষিটা বেশিই করো। মনে হয় ঝামা দিয়া পাতিল ঘষতাছো।
পরিস্থিতিটা ছবেদ নাপিতের প্রতিকূলে চলে যায়। তার আশঙ্কা হয় এমন জনরোষ হলে তো ময়াল হাতছাড়া হয়ে যাবে। অহী নাপিত তো এ ময়ালে আসার জন্য একপায়ে খাড়া। সে তখন সুর নরম করে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক এই সময় মান্না সরদার চলে আসে। ছবেদ আলি মান্না সরদারকে দেখে মনে মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। সে গম্ভীর হয়ে থাকে।
মান্না সরদার ছবেদকে লক্ষ্য করে বলে, কি ও ভাই, কামাইতে আইসছিলাম। কামান যাইব কি?
ছবেদ আলি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না। সে রাগত স্বরে বলে, এইডা কোন জাতের কথা? কামানো আবার কি? সেই দিনও তুমি খারাপ কথা কইছো। তোমার মুখে কি আল্লাহতালা ভালা কথা দেয় নাই?
আবেদালি মণ্ডল ছবেদকে বলে, কি রে ছবেদ, মান্না তরে কি খারাপ কথা কইছিলো?
-- না কাহা, ওই খবিশ কথা আমি মুখে আনতে পারমু না।
-- মুখে না আনলে খবিশ কী না বুঝব কিবায়?
-- কইলে আপনেরা শরম পাবেন।
--- শরম পামু না ক। শরম এত সস্তা না।
-- তাইলে শোনেন, সেদিন চুল কাটাতে আইসা সে আমারে একটু দূরে নিয়ে যাইয়া কয় এই, কামাতে কয় পয়সা লাগে।
আমি কইলাম কামানো মানে, মাথা কামানো?
সে কয়, আরে না সব কামানো। শোনে তো আমার অক্ত গরম হইয়া গেল। আচ্ছা কনছে, এমন খবিশ কথা কি কেউ কয়?
সবাই মান্না সরদারের রসিকতাটা বুঝে। খিলখিল করে হাসে। কেবল ছবেদ আলি বোকার মত তাকিয়ে থাকে। এমন খবিশ কথাও যে হাসির খোরাক হতে পারে সেটা তার মাথায় ঢুকে না।
এই হাসাহাসির মাঝেই আসে সত্তরোর্ধ মহীউদ্দীন । বুড়ো মানুষ। তাকে বসিয়ে রাখা যায় না। সবাই বলে, চাচাকে আগে কেটে দাও।
মহীউদ্দীন বলে, কী সব বলছো। আমি বুড়ো মানুষ আর আমাকে কী না আগে কাটবে।
মুরুব্বি গোছের কে যেন বলে, না না চাচা। আপনেরে কাটব কে রে। আপনের চুল কাটার কথা কইতাছে।
মহীউদ্দীন বলে, মাথার চুলগুলো সুন্নতি কায়দায় কাটো। দাড়িগুলো ছেটে দাও।
সুন্নতীকেতায় মাথার চুল ছাঁটা হল ঠিকই কিন্তু দাড়ি কেটে জোয়ানের দাগ দাড়ি বানিয়ে ফেলল। মহীউদ্দীন তো দাড়িতে হাত দিয়েই চটে গেল।
আরে বেটা, এটা কী করছস? এভাবে কেউ দাড়ি কাটে? এটা গণিমতের মাল পাইছস যেমন ইচ্ছে তেমন করে কাটবি?
ছবেদ আলি বলে, না গো চাচা। চুলের সাইজের সাথে দাড়ির সাইজের তো ম্যাচিং করে দিলাম। তা না হইলে তো বুড়া বান্দরের মত দেখা যাইব।
মহীউদ্দীন রাগে গরগর করতে করতে বলে, আমার কী এখন বিয়ে করার বয়স?
কথা বলতে বলতেই মহীউদ্দীনের কানের উপর লম্বা লম্বা
পশমগুলো ঘ্যাচাঘ্যাচ কেটে ফেলে।তারপর মোটা মোটা ভুরু জোড়ায় কাঁচি চালাতে থাকে।
আবেদালি মণ্ডল মহীউদ্দীনকে বলে, একবার আরশি ধইরে দেখেন। ছবেদ আলি আপনেরে বিশ বছরের জোয়ান বানাইয়া ফালছে।
মহীউদ্দীন আবেদ আলিকে আয়না বের করতে বলে। আবেদ আলি আয়না বের করে মহীউদ্দীনের সামনে ধরে। মহীউদ্দীন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারে না। তার গাঙচিলের মত জোড়ভুরু কেটে ছনক্ষেত বানিয়েছে আর কানের উপর চুলগুলো শ্মশানে পরিণত হয়েছে। সে নিজেই নিজেকে হুতোমের আকৃতিতে প্রত্যক্ষ করল।
মহীউদ্দীন ঝট করে উঠে নরসুন্দরের কালো গালে ঠাস করে কষে দিল দুই বাদশাহি তামেচা। তারপর গজরগজর করতে করতে বাড়ির পথ ধরলো। নরসুন্দর ছবেদ আলি পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমার পয়সাডা দিবেন না?
মহীউদ্দীন বলল, আমার দাড়ি যেমন ছিল তেমন করে দে। আমার কানের চুল যেমন ছিল তেমন করে দে। এই শালীমুন্দীর পুত, আমার ভুরু কাটছস ভুরু ঠিক করে দে। বলতে বলতে সে চলে গেল। ছবেদ আলি হা করে চেয়ে রইল।
ছবেদ আলি কাজ যেমনি করুক কিন্তু তার নিজের কাজের প্রশংসায় সে পঞ্চমুখ ছিল। সে বাবার উপর রাগ করে লখনৌ গিয়ে এই পেশা শিখে এসেছে। একবার বোম্বাই গিয়ে তার ওস্তাদের কাছে নায়ক দীলিপ কুমারের মাথাও ছাটতে দেখেছে।
আজকাল তার ময়ালের লোকজন তার কাছে আর বেশি আসে না। সময় বদলে গিয়েছে। বাজারে বটগাছের নিচে সারি সারি টোল পেতে নরসুন্দররা বসে থাকে। লোকজন সেখানে গিয়ে ক্ষৌরী করে। সেখানে নরসুন্দররা উটমার্কা পলমল সাবান দিয়ে চুল নরম করে কাটে। ছবেদ আলির মত পানি দিয়ে ঘষতে ঘষতে চামড়ার বারোটা বাজায় না।
একটু সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষ যারা তারা টোলেও ক্ষৌরী করতে যায় না। উলিয়াবাজারে নরসুন্দর আবছার আলি আধুনিক সেলুন চালু করেছে। সেখানে চেয়ারে বসে আরাম করে চুল দাড়ি কাটে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচিরও পরিবর্তন ঘটে। মানুষের জীবনাচরণেও তার প্রভাব পড়ে।
আবছার আলি নরসুন্দর একখণ্ড পোড়া টিনের উপর চুন দিয়ে লিখে একটা সুখপাঠ্য ও দৃষ্টিনন্দন সাইনবোর্ড টানিয়েছে। সাইনবোর্ডটি এরকম
আবছার ছেলুন
এখানে কম খরছে সকল রকম চুল কামানো যায়।
এখানে ছেয়ারে বসিয়া গুমাইতে গুমাইতে আরামে সকল প্রকার চুল কামানো যায়।
বড় আয়নায় মুখ দেখা যায়।
আজিম,এজ্জাক,পারুক,আলংগীরের ইসটাইলে চুল কাটা যায়।
মুখে তিব্বত গন্ধরাজ সাবান ঘসিয়া দাড়ি কাটা হয়।
সকাল বিকাল খুর শান দেয়া হয়।
দাড়ি কাটিয়া গালে পমেট ঘসিয়া দেয়া হয়।
খরছ: গোল ছাট বারো আনা
নায়ক ইসটাইল একটেকা ছার আনা।
মাথা কামাইতে আট আনা।
দুঃখু পাইলে টেকা ফেরত।
এই অভিনব কায়দার সেলুন দেখে উঠতি বয়সের পোলাপান দলে দলে সেখানে এসে চুল কাটে। গরীব আর কৃপণরা বটতলায় গিয়ে টোলে বসে।
এভাবে দিন বদলের সাথে সাথে ছবেদ আলি নরসুন্দর রা প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। এক সময় ক্ষুর কাঁচি বেকার হয়ে যায়। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় পেশাও বদলে যায়।
২৪/৯/২০২৩
ময়মনসিংহ
নরসুন্দরের সাথে শৈশব জড়িয়ে নেই এমন মানুষ খুব কমই আছে। শৈশব কৈশোর তারুণ্যের দিনগুলোতে অনেক রঙিলা নরসুন্দরের সাথে দেখা হয়েছে। তাদের কাছে মাথার চুল কেটেছি। এমনকি জাতক ঘর থেকে বেরিয়ে নবজাতকের ক্ষৌরি করাও দেখেছি। দেনা পাওনা নিয়ে নরসুন্দরদের বাতচিতও মনে রাখার মত।
আগের দিনে নাপিত,স্বর্ণকার এবং গোটকা মানে খৎনাকরনেওয়ালাদের ময়াল বা মহল ভাগ করা থাকত। কারো এলাকায় অন্য কেউ ঢুকতে পারত না।
আমাদের এলাকার অধিপতি ছিল ছবেদ আলি নরসুন্দর। ছোট খাটো চেহারা। মুখ খুললে ঝিঁঝি পোকার মত ক্যের ক্যের শব্দ হত। মর্দ আর শব্দে বিস্তর ব্যবধান ছিল।
তার বাড়িতে একটি ছনের ঘরে সে বসত।আধুনিক সেলুনের সেকেলে সংস্করণ যাকে বলে। সৌখিন লোকেরা তার বাড়িতে গিয়ে সেই সেলুনে টোলে বসে চুল কাটাতো। সপ্তাহে একদিন সে তার সেলুনে বসে ক্ষুর চালাত।
নরসুন্দর ছবেদ আলি সপ্তাহের বাকি ছ'দিন গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ক্ষৌরকর্ম করে বেড়াত। হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর কাঁচি, ক্ষুর,কাঠের ঢাকনা দেয়া রূপবানের ছবিযুক্ত আরশি আর একটা ভাঙা স্লেট। সেই স্লেটে মাঝে মাঝে ক্ষুর ধার দিত।
জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর বেলায় গেরস্থ বাড়ির দহলিজে বসতো। নিজে একখানা পিঁড়ির উপর বসত এবং সামনে আর একটা পিড়ি রাখতো।
আজকের মত তখনকার দিনের বাবারা এত হিসেবি বা অক্ষম ছিলেন না। তাদের গণ্ডা গণ্ডা পোলাপান থাকত। হয়তো জন্মশাসন প্রথা তখনও চালু হয় নি। তারা চারজন, পাঁচজন সর্বোচ্চ আট দশজন পোলাপান নিয়ে নাপিতের কাছে এসে বলতেন, এদের চামছাটা করে দাও।
চামছাট অনেকটা মাথামুণ্ডনের মত। নাপিতের সময় কম লাগে বলে চামছাটের খরচ আট পয়সা বা দুআনা।
ছেলে ছোকরারা চাইত দীলিপ ছাট বা উত্তম কুমারের মত ছাট। এ ধরনের ছাটে ছোটদের জন্য চৌদ্দ পয়সা বা সাড়ে তিন আনা আর বড়দের জন্য চার আনা।
অভিভাবক নাপিতের কাছে হাওলা করে দিয়ে চলে যেতেন। ছেলেছোকরারা ঘাঁইঘুই করত। কেননা,ওরা চামছাট পছন্দ করে না। ওরা চায় দীলিপকুমার বা উত্তম কুমারের মত ফ্যাশন করতে। তাই চাল বিক্রি করে আগেই ওরা গাঁটে পয়সা বেঁধে নিয়ে যেত। নরসুন্দরের সাথে গোপন চুক্তি করে পছন্দমত দীলিপ ছাট নিয়ে নিত।
ঘটনাটা বিষাক্ত হয়ে উঠত নাপিত যখন ক্ষুর চালাতো। বাটি থেকে পানি নিয়ে ঘষতো। আর এমন দানবীয় ঘষায় মনে হত চামড়া ছিড়ে যাচ্ছে। পোলাপানের কাছে অসহ্য হলেও রা কাড়তো না। তারপর যখন ক্ষুর চালাত তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। মনে হত এতো চুল কাটা নয় যেন ভুটিয়া সামারু মরা গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছে।
অনেক সময় নির্মম নরসুন্দরের বেদিশা ক্ষুর চালানোর ফলে দুর্ঘটনাও ঘটতো।
সে বার মিয়ারুদ্দি এসেছিল চুল কাটাতে। চুলে কাঁচির কাজ শেষ হওয়ার পর ক্ষুর লাগানোর জন্য পানি দিয়ে ঘষা শুরু করেছে ঠিক তখনই মেজাজি মিয়ারুদ্দিন লাফ দিয়ে
উঠে ক্রোধে বলতে লাগল, অমুকের ( অমুকের স্থলে এমন অশ্লীল এবং অশ্রাব্য শব্দ প্রয়োগ করেছিল যা ভদ্রলোকের শ্রুতি স্তব্ধ করার মত) পানি দিয়ে ঘষতে ঘষতে তো চামড়ার বারোটা বাজালে। ধুর শালা, অমুকের চুলই আর ছাটব না।
ছবেদ আলি মিয়ারুদ্দির এমন আচরণে প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে সহসাই নিজেকে সামলে নিল। তারপর বলল, অমন গুলি খাওয়া মইষের নাহাল খাড়ইয়া পড়লে কে রে?
খাড়ইমু না? শালা তুমি পানি দিয়া ঘইষা ঘইষা আমার চুল চামড়া সব তুইলা ফালছো। ইসঃ কেমন জ্বলা জ্বলতাছে। আর চুল কাটমু না। বাইত যাইয়ে বউকে কমু কমেট বেলেড দিয়ে চাইচ্চে দিব। শালার নাপিতের গোষ্ঠী কিলাই।
মিয়ারুদ্দির সাথে সবাই সংহতি প্রকাশ করে। আবেদালি মণ্ডল গণ্যমান্য লোক। সেও বলে, না গো ছবেদ, তুমি ঘষাঘষিটা বেশিই করো। মনে হয় ঝামা দিয়া পাতিল ঘষতাছো।
পরিস্থিতিটা ছবেদ নাপিতের প্রতিকূলে চলে যায়। তার আশঙ্কা হয় এমন জনরোষ হলে তো ময়াল হাতছাড়া হয়ে যাবে। অহী নাপিত তো এ ময়ালে আসার জন্য একপায়ে খাড়া। সে তখন সুর নরম করে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক এই সময় মান্না সরদার চলে আসে। ছবেদ আলি মান্না সরদারকে দেখে মনে মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। সে গম্ভীর হয়ে থাকে।
মান্না সরদার ছবেদকে লক্ষ্য করে বলে, কি ও ভাই, কামাইতে আইসছিলাম। কামান যাইব কি?
ছবেদ আলি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না। সে রাগত স্বরে বলে, এইডা কোন জাতের কথা? কামানো আবার কি? সেই দিনও তুমি খারাপ কথা কইছো। তোমার মুখে কি আল্লাহতালা ভালা কথা দেয় নাই?
আবেদালি মণ্ডল ছবেদকে বলে, কি রে ছবেদ, মান্না তরে কি খারাপ কথা কইছিলো?
-- না কাহা, ওই খবিশ কথা আমি মুখে আনতে পারমু না।
-- মুখে না আনলে খবিশ কী না বুঝব কিবায়?
-- কইলে আপনেরা শরম পাবেন।
--- শরম পামু না ক। শরম এত সস্তা না।
-- তাইলে শোনেন, সেদিন চুল কাটাতে আইসা সে আমারে একটু দূরে নিয়ে যাইয়া কয় এই, কামাতে কয় পয়সা লাগে।
আমি কইলাম কামানো মানে, মাথা কামানো?
সে কয়, আরে না সব কামানো। শোনে তো আমার অক্ত গরম হইয়া গেল। আচ্ছা কনছে, এমন খবিশ কথা কি কেউ কয়?
সবাই মান্না সরদারের রসিকতাটা বুঝে। খিলখিল করে হাসে। কেবল ছবেদ আলি বোকার মত তাকিয়ে থাকে। এমন খবিশ কথাও যে হাসির খোরাক হতে পারে সেটা তার মাথায় ঢুকে না।
এই হাসাহাসির মাঝেই আসে সত্তরোর্ধ মহীউদ্দীন । বুড়ো মানুষ। তাকে বসিয়ে রাখা যায় না। সবাই বলে, চাচাকে আগে কেটে দাও।
মহীউদ্দীন বলে, কী সব বলছো। আমি বুড়ো মানুষ আর আমাকে কী না আগে কাটবে।
মুরুব্বি গোছের কে যেন বলে, না না চাচা। আপনেরে কাটব কে রে। আপনের চুল কাটার কথা কইতাছে।
মহীউদ্দীন বলে, মাথার চুলগুলো সুন্নতি কায়দায় কাটো। দাড়িগুলো ছেটে দাও।
সুন্নতীকেতায় মাথার চুল ছাঁটা হল ঠিকই কিন্তু দাড়ি কেটে জোয়ানের দাগ দাড়ি বানিয়ে ফেলল। মহীউদ্দীন তো দাড়িতে হাত দিয়েই চটে গেল।
আরে বেটা, এটা কী করছস? এভাবে কেউ দাড়ি কাটে? এটা গণিমতের মাল পাইছস যেমন ইচ্ছে তেমন করে কাটবি?
ছবেদ আলি বলে, না গো চাচা। চুলের সাইজের সাথে দাড়ির সাইজের তো ম্যাচিং করে দিলাম। তা না হইলে তো বুড়া বান্দরের মত দেখা যাইব।
মহীউদ্দীন রাগে গরগর করতে করতে বলে, আমার কী এখন বিয়ে করার বয়স?
কথা বলতে বলতেই মহীউদ্দীনের কানের উপর লম্বা লম্বা
পশমগুলো ঘ্যাচাঘ্যাচ কেটে ফেলে।তারপর মোটা মোটা ভুরু জোড়ায় কাঁচি চালাতে থাকে।
আবেদালি মণ্ডল মহীউদ্দীনকে বলে, একবার আরশি ধইরে দেখেন। ছবেদ আলি আপনেরে বিশ বছরের জোয়ান বানাইয়া ফালছে।
মহীউদ্দীন আবেদ আলিকে আয়না বের করতে বলে। আবেদ আলি আয়না বের করে মহীউদ্দীনের সামনে ধরে। মহীউদ্দীন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারে না। তার গাঙচিলের মত জোড়ভুরু কেটে ছনক্ষেত বানিয়েছে আর কানের উপর চুলগুলো শ্মশানে পরিণত হয়েছে। সে নিজেই নিজেকে হুতোমের আকৃতিতে প্রত্যক্ষ করল।
মহীউদ্দীন ঝট করে উঠে নরসুন্দরের কালো গালে ঠাস করে কষে দিল দুই বাদশাহি তামেচা। তারপর গজরগজর করতে করতে বাড়ির পথ ধরলো। নরসুন্দর ছবেদ আলি পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমার পয়সাডা দিবেন না?
মহীউদ্দীন বলল, আমার দাড়ি যেমন ছিল তেমন করে দে। আমার কানের চুল যেমন ছিল তেমন করে দে। এই শালীমুন্দীর পুত, আমার ভুরু কাটছস ভুরু ঠিক করে দে। বলতে বলতে সে চলে গেল। ছবেদ আলি হা করে চেয়ে রইল।
ছবেদ আলি কাজ যেমনি করুক কিন্তু তার নিজের কাজের প্রশংসায় সে পঞ্চমুখ ছিল। সে বাবার উপর রাগ করে লখনৌ গিয়ে এই পেশা শিখে এসেছে। একবার বোম্বাই গিয়ে তার ওস্তাদের কাছে নায়ক দীলিপ কুমারের মাথাও ছাটতে দেখেছে।
আজকাল তার ময়ালের লোকজন তার কাছে আর বেশি আসে না। সময় বদলে গিয়েছে। বাজারে বটগাছের নিচে সারি সারি টোল পেতে নরসুন্দররা বসে থাকে। লোকজন সেখানে গিয়ে ক্ষৌরী করে। সেখানে নরসুন্দররা উটমার্কা পলমল সাবান দিয়ে চুল নরম করে কাটে। ছবেদ আলির মত পানি দিয়ে ঘষতে ঘষতে চামড়ার বারোটা বাজায় না।
একটু সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষ যারা তারা টোলেও ক্ষৌরী করতে যায় না। উলিয়াবাজারে নরসুন্দর আবছার আলি আধুনিক সেলুন চালু করেছে। সেখানে চেয়ারে বসে আরাম করে চুল দাড়ি কাটে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচিরও পরিবর্তন ঘটে। মানুষের জীবনাচরণেও তার প্রভাব পড়ে।
আবছার আলি নরসুন্দর একখণ্ড পোড়া টিনের উপর চুন দিয়ে লিখে একটা সুখপাঠ্য ও দৃষ্টিনন্দন সাইনবোর্ড টানিয়েছে। সাইনবোর্ডটি এরকম
আবছার ছেলুন
এখানে কম খরছে সকল রকম চুল কামানো যায়।
এখানে ছেয়ারে বসিয়া গুমাইতে গুমাইতে আরামে সকল প্রকার চুল কামানো যায়।
বড় আয়নায় মুখ দেখা যায়।
আজিম,এজ্জাক,পারুক,আলংগীরের ইসটাইলে চুল কাটা যায়।
মুখে তিব্বত গন্ধরাজ সাবান ঘসিয়া দাড়ি কাটা হয়।
সকাল বিকাল খুর শান দেয়া হয়।
দাড়ি কাটিয়া গালে পমেট ঘসিয়া দেয়া হয়।
খরছ: গোল ছাট বারো আনা
নায়ক ইসটাইল একটেকা ছার আনা।
মাথা কামাইতে আট আনা।
দুঃখু পাইলে টেকা ফেরত।
এই অভিনব কায়দার সেলুন দেখে উঠতি বয়সের পোলাপান দলে দলে সেখানে এসে চুল কাটে। গরীব আর কৃপণরা বটতলায় গিয়ে টোলে বসে।
এভাবে দিন বদলের সাথে সাথে ছবেদ আলি নরসুন্দর রা প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। এক সময় ক্ষুর কাঁচি বেকার হয়ে যায়। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় পেশাও বদলে যায়।
২৪/৯/২০২৩
ময়মনসিংহ