জরীফ উদ্দীন:
আজ ২৫ বৈশাখ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী। অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি , নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে । এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি , জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। এখান থেকে হিমালয়। এভাবে বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখার সূত্রপাত।
১২৮৪ সালে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদনের "মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা ", ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং " ভিখারিণী" ও "করুণা " নামে দুটি গল্প। এর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী। অবিভাবকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পেয়ে শেষে স্থির করলেন বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টার হবেন। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর (পরে নাম পরিবর্তন করে মৃণালিনী দেবী) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯০২সালে মৃণালিনী মারা যান। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কবি। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য কবিগুরু শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। তার সম্পাদনায় ভারতী, সাধনা, বঙ্গদর্শন প্রভৃতি পত্রিকা বের হয়।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস এবং ৩৬টি প্রবন্ধ রয়েছে। আর অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উল্লেখযোগ্য রচনা কাব্যগ্রন্থঃ 'মানসী, সোনার তরী, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, রাজা ও রাণী, বলাকা, গীতবিতান, নৈবেদ্য, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি। উপন্যাসঃ ঘরে-বাইরে, শেষের কবিতা, গোরা, চার অধ্যায়, চতুরঙ্গ ইত্যাদি । ‘ছিন্নপত্র’ তার অবিস্মরণীয় পত্রসাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। আর ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন ‘শান্তি নিকেতন’।
৮০ বছর বয়সে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবিগুরু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান ব্যক্তি।